মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুক
আমার প্রথম আগ্রহের বিষয় ছিল গণিত। বিস্ময়করভাবে। খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। গণিত ভালোবাসতাম। জটিল সব সমস্যার সমাধান করতে ভালো লাগত। সব সময় ভাবতাম, প্রকৌশলী হব। কেননা গণিত আর প্রকৌশলের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে।
অথচ আমার প্রথম চাকরি ছিল পত্রিকা বিলি। তখন ১২ বছর বয়স। ভোর তিনটায় ঘুম থেকে উঠতাম। পত্রিকা সংগ্রহ করে বিলি করা শুরু করতাম। বাড়ি ফিরে স্কুলে যাওয়ার আগে ছোট্ট একটা ঘুমও দেওয়া হয়ে যেত। মূলত পত্রিকা বিলির কাজটা করেছিলাম বলেই কলেজে যেতে পেরেছিলাম। আমার পরিবারে আমিই প্রথম, যে কলেজ পর্যায়ে পা রেখেছি। জানতাম, কলেজে ভর্তি হতে পারাটা একটা সুযোগ। কোনোভাবেই সেই সুযোগ নষ্ট করতে চাইনি।
স্টিভ জবসের সঙ্গে যেদিন প্রথম কথা হলো, সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি খুবই অন্য রকম একজন সিইও। তাঁর কাছে পণ্যই (প্রোডাক্ট) ছিল শেষ কথা। তিনি সব সময় ‘ছোট দল’–এর ওপর বিশ্বাস রাখতেন। তাঁর ভাবনাগুলো ভীষণ ভালো লেগেছিল। আরেকটা ব্যাপার ভালো লেগেছিল। সবাই যখন ‘এন্টারপ্রাইজ’ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়তে চাইছিল, স্টিভের মনোযোগ ছিল শুধুই ভোক্তার দিকে। সেই সময়ে সবাই ভাবতে শুরু করেছিল, স্রেফ ভোক্তার কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে বড় হওয়া যাবে না।
বুঝতে পারছিলাম, সব সৃজনশীল, মেধাবী মানুষের সঙ্গে কাজ করার একটা সুযোগ হয়েছে। অনেকের হয়তো মনে নেই, অ্যাপল কিন্তু একসময় দেউলিয়া হতে যাচ্ছিল। খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল তখন। লোকে আমাকে বলেছিল, অ্যাপলে যোগ না দিতে। কারণ, সবাই দেখতে পাচ্ছিল, কোম্পানিটা দিন দিন নিচের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু আমি একটা কিছু দেখেছিলাম। স্টিভের চোখে এক ধরনের দ্যুতি আমার নজর এড়ায়নি। এখন ভাবি, ভাগ্যিস সেই দলটাতে যোগ দিয়েছিলাম।
স্টিভ আমাকে উদ্ভাবনের গুরুত্ব শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন, ছোট ছোট দল কেন জরুরি। আমি যখন যোগ দিই, তখন ‘আইপড টিম’, ‘আইফোন টিম’কে কাছ থেকে দেখেছি। খুবই ছোট ছোট দল ছিল। স্টিভের মূলমন্ত্রই ছিল—সেরা মানুষগুলোকে নাও। এমন লোক নাও, যাঁরা এমন কিছু জানে, যা তুমি জানো না। এরপর এই লোকগুলোর ওপর বিশ্বাস রাখো।
একটা ধারণা আঁকড়ে ধরে বসে থাকার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। নতুন জ্ঞান, নতুন ধারণা সামনে পেলে স্টিভ সহজেই নিজের স্থান থেকে সরে আসতেন। শুরুর দিকে তাঁর এই মানসিকতার সঙ্গে আমি ঠিক খাপ খাওয়াতে পারিনি। পরে বুঝেছি, এটা খুব জরুরি। খুব কম মানুষই তাঁদের পুরোনো ধ্যানধারণা থেকে সরে আসতে পারেন। এটা একটা অসাধারণ দক্ষতা।
স্টিভ তর্ক করতে ভালোবাসতেন। চাইতেন, কেউ তাঁর চিন্তাকে প্রশ্ন করুক। যদি দারুণ কোনো আইডিয়া থাকে, আপনি অবশ্যই স্টিভের মন বদলে দিতে পারবেন। আমরা একে অপরের মন বদলে দিতে পেরেছিলাম বলেই কাজটা ভালো হয়েছে।
কীভাবে একটা জিনিস তৈরি হয়—এই রহস্য আমাকে সব সময় কৌতূহলী করে। বিভিন্ন কারখানা ঘুরতে খুব ভালো লাগে। ঘুরে ঘুরে দেখি, কীভাবে জিনিসপত্র তৈরি হয়। আমি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করেছি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং মূলত এটাই শেখায়—কীভাবে মানুষ ও যন্ত্র এক হয়ে এমন কিছু তৈরি করতে পারে, যা তারা একা পারে না। ‘সাপ্লাই চেইন’ এমন এক জিনিস, আপনি যদি ঠিকভাবে করতে পারেন, এটি একটা শিল্পের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। হাজারো টুকরা টুকরা যন্ত্রাংশ এক হয়ে যেভাবে একটা যন্ত্র তৈরি হয়, এটা তো ‘সিম্ফনি’র মতোই।
আমি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। উঠেই ম্যাক নিয়ে বসি, ই–মেইল চেক করি। বেশির ভাগ ই–মেইলই আসে ক্রেতাদের কাছ থেকে। তাঁরা আমাকে জানান, আমাদের পণ্যের কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নতি দরকার। কিছু ই–মেইল ইতিবাচক, কিছু আবার ইতিবাচক নয়। কারণ, মানুষ যখন বলে, মন খুলেই বলে। আমি মনে করি, এটা একটা দারুণ ব্যাপার। কারণ, এর মাধ্যমে আমি বুঝতে পারি, আমরা ঠিক পথে চলছি কি না।
সত্যি বলতে আমার চামড়া কিছুটা মোটা। সমালোচনা এলে প্রথমেই গায়ে মাখি না। বোঝার চেষ্টা করি, যা বলছে, তা সত্যিই কি না। শুরুতেই আত্মরক্ষার ঢাল তুলে বসি না। আমরা যা করছি, সেটা কেন ঠিক, প্রমাণ করার চেষ্টা করি না।
অনেক সিইও বলেন, তাঁদের কাজটা কতটা কঠিন। কিন্তু বলেন না, তাঁদের কাজ কতটা মজার। আমার কাজটা কিন্তু আমার খুব পছন্দের।
অথচ এখানে যে পৌঁছাব, কখনো কল্পনাও করিনি। ডিউক ইউনিভার্সিটিতে যখন স্নাতক করছি, পরবর্তী ২৫ বছরের একটা পরিকল্পনা করেছিলাম। প্রথম ১-২ বছর পরিকল্পনামাফিক গেছে। পরের বছরগুলোতে আর কিছুই মেলেনি। জীবন সব সময় আপনার সামনে এমন কিছু হাজির করবে, যা আপনার কল্পনায় ছিল না। এই অপরিকল্পিত জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন কি না, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।