বাবাহীন জীবন কি আদতেই জীবন নাকি দুঃস্বপ্ন?

বাবা হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে মেয়ে আমবারীন আতিশা সিরাজী
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সৃষ্টিশীলতা আমার রক্তে থাকার কথা ছিল, কিন্তু সবকিছু কি আর নিয়ম মেনে হয়? উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে গবেষণাবিষয়ক প্রবন্ধ লেখা পর্যন্তই আমার দৌড়। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করাটাও তাই আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। কিন্তু আজ আমি আমার বাবাকে নিয়ে দুটো কথা বলতে বসেছি বলেই হয়তো সাহস জোটাতে পারলাম। লিখতে বসে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অনেক স্মৃতি, অনেক কথা; এ বলে, আমায় নাও, ও বলে, আমায় লেখো। কিন্তু আমি কতটাই বা পারি! তাও চেষ্টা করছি। আজ বাবার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, প্রকৌশলী হাবীবুল্লাহ সিরাজীর আমি জ্যেষ্ঠ কন্যা। আমার বাবা আমার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষ, শ্রেষ্ঠ বাবা। সবাই নিজের বাবাকে ভালোবাসে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার বাবা যিনি কিনা এক যুগ ধরে তাঁর প্রবাসী কন্যা আর দৌহিত্রীর সব রকম দায়িত্ব নিয়ে তাদের রক্ষাকবচ হয়ে আগলে ছিলেন, তাঁর তুলনা মেলা অসম্ভব। আমার প্রাণভোমরাটি একটি ছোট্ট রুপার কৌটার মধ্যে ভরে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন তিনি। যাওয়ার বেলায় সেই কৌটা আর ফিরিয়ে নেওয়া হলো না! সেই সঙ্গে চলে গেল আমার স্মৃতিশক্তি, আমার মেধা, আত্মবিশ্বাস আর কর্মদক্ষতা। শুধু মনে আছে সেই ভয়াবহ একটি মাস, আমার জীবনের নিকষ কালো একটা অধ্যায়, যখন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ব্যাকুল হয়ে বসে থাকতাম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের দরজার সামনে, যদি একঝলক বাবাকে দেখা যায়! জীবনের শেষ একটি মাস তিনি কৃত্রিম শ্বাস–প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে ছিলেন সেখানে। আমার সঙ্গে আর তাঁর কথা হয়নি! কানাডা থেকে অনেক কসরত করে যখন ঢাকায় পৌঁছালাম, তখন তিনি অন্য ভুবনের বাসিন্দা। হয়তো সব শুনতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু প্রকাশ করার ক্ষমতা ছিল না। জ্ঞান এসেছিল, দুইবার। আমার বিশ্বাস, আমাকে আর তাঁর আদরের নানাজিকে দেখে অপার্থিব হাসি ছিল মুখে সেই ক্ষণে। যেমনটি দেখতাম প্রতিবছর, ঢাকা বিমানবন্দরে এসে কাচের জানালার ওপাশে অপেক্ষারত বাবার মুখে। আমার মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন বাবা সেই দিন, যেন ছুটে না যায়। কী আনন্দ হয়েছিল, বাবা বুঝি মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এলেন। আমার বাবা—আমার আব্বু। হাউমাউ করে কাঁদছিল আমার মেয়ে, নানাজির জ্ঞান এসেছে। তখন কি আর জানতাম যে পরম করুণাময় আমাদের একটা সুযোগ দিয়েছিলেন মাত্র, জীবনরসটুকু শেষবারের মতো শোষণ করে নেওয়ার জন্য। তারপরই যে শুরু হবে অক্লিষ্ট খরা।

এবার কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কথা একটু বলি। বুয়েটের যন্ত্রপ্রকৌশলী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সম্পূর্ণ সত্তাজুড়ে ছিল কবিতা। তাই তো বিশাল ভবন নির্মাণের পাশাপাশি কবিতার খসড়া নিয়ে কাটাকুটি করতে দেখেছি কত শতবার।

বাবার অধীনে চাকরিও করেছেন মেয়ে আমবারীন আতিশা সিরাজী

বাবাকে অনুসরণ করেই আমার প্রকৌশলী হওয়া। আমি এতই ভাগ্য করে এসেছিলাম যে কাজও করতাম একই দপ্তরে, তাঁর অধীনে। তাই দিনের অনেকটা সময়ই কাটত তাঁর সঙ্গে। যদিও খুব কম বয়সে নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছিলাম তাঁর অমতে, মাস কাটতেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে অকপটে ক্ষমাও চেয়েছি। বাবা আমার স্নেহের আধার, মাফ করে দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ। সেই থেকে যেন আরও লেপটে ছিলাম বাবার সঙ্গে। শুধু সাংসারিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রকৌশলী হাবীবুল্লাহ সিরাজী কাজ করে গেছেন আজীবন। আর মনের খোরাক জোটানোর জন্য আশ্রয় নিতেন লেখনীর। কবিতা উৎসবের মিছিলে বাবার আনন্দে ঝলমলে মুখশ্রী দেখেছি। জাতীয় কবিতা পরিষদের পরিচালক হিসেবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাবা যখন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছিলেন, আবেগের আতিশয্যে আনন্দাশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। দেশে–বিদেশে যেকোনো কবিতা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে বাবার সে কী উত্তেজনা! এপার বাংলা-ওপার বাংলা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা সর্বত্রই ছিল তাঁর পদচারণ। আর তাই তো তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছিল বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, যশোর সাহিত্য পুরস্কার, বিষ্ণু দে পুরস্কার, রূপসী বাংলা পুরস্কার, কবিতালাপ পুরস্কার, আরও কত কী! সম্মাননা পেয়েছেন একাধিক: লা ফর্টিনা, বুয়েট ৭০, জলাঙ্গী, সংহতি ইত্যাদি।

কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী

বঙ্গবন্ধু আর জননেত্রীর প্রতি বাবার ভালোবাসা ছিল অন্ধের মতো! ব্যক্তিগতভাবে জননেত্রীও বাবাকে পছন্দ করতেন; প্রায়শই ডেকে পাঠাতেন। বাবা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেলেন, যেন তাঁর সারা জীবনের অপেক্ষার ইতি ঘটলো। এবার তিনি বাঁচবেন নিজের জন্য, সাহিত্যের জন্য। আহা, কী সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। ছোটবেলা থেকে ভিড় ঠেলে যে বইমেলায় গেছি, সেই মেলা আয়োজন করবেন এখন আমার বাবা! আব্বুও ছিলেন খুবই আনন্দিত। সেই ভোর থেকে রাত ৮টা–৯টা পর্যন্ত পরিশ্রম করে বাড়িতে এসেছেন। মুখে ক্লান্তির ছাপ কিন্তু চোখ দুটো আনন্দে ঝলমল করছে। সারাক্ষণ মুঠোফোন বেজেই চলেছে। প্রতিদিন বাংলা একাডেমিতে তাঁর কক্ষটি পূর্ণ হয়ে থাকত ফুল, মিষ্টি আর উপহারে, যা তিনি সহকর্মীদের বিলিয়ে দিয়ে আসতেন। আন্তরিকতা আর মিষ্টভাষণ শিগগিরই বাবাকে সবার প্রিয় পাত্রে পরিণত করল। ৭০ বছর বয়সে এসে আমার বাবা যেন তাঁর সারা জীবনের সাধনাকে বাস্তবে রূপ দিলেন।

আমার আব্বু, সেই অসীম ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর ‘আম্মা’কে একটি দিনও ফোন করতে ভোলেননি। কত দিন হলো আমাকে কেউ ‘আম্মা’ বলে ডাকে না। দিন–রাত কেটে যায়, ফোনের পর্দায় অপলক তাকিয়ে থাকি সেই চেনা নম্বরটি দেখার জন্য। ফোন তো আর আসে না। আমার অবিরাম অশ্রুধারায় কানাডার রাজপথ ভিজে যায়, আমার বুকফাটা আর্তনাদের ওরা নির্বাক সাক্ষী হয়ে থাকে। আর কত দিন এভাবে বাঁচতে হবে? আব্বু, আমাকে তোমার কাছেই নিয়ে যাও, প্লিজ। আমি যে তোমায় ছাড়া বাঁচতে অভ্যস্ত নই।