শখের বাগানে পোকামাকড়ের আনাগোনা দেখলে কার না কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ব্যতিক্রম আশিফুল হক। পোকাদের দেখে তিনি মুগ্ধ হন, যত্ন করে তাদের ছবি তোলেন। গত তিন বছরে ঢাকায় তাঁর ছাদবাগান থেকেই শতাধিক প্রজাতির হাজারের বেশি ছবি তুলেছেন। ‘আই ন্যাচারালিস্ট’ নামে প্রকৃতিপ্রেমীদের একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে সেসব ছবি তুলে দিয়েছেন শখের এই আলোকচিত্রী। ২২ নভেম্বর সকালে তাঁর বাগানে ঢুঁ মেরে এসেছেন সজীব মিয়া
ছাদবাগানেও এত পোকামাকড় থাকে?
প্রশ্নটা করে ইতস্তত করছিলাম। কারণ, আমার প্রশ্নে যে সুপ্ত সন্দেহের রেশ মিশে আছে। তবে সেই সংকোচ আশিফুল হকের হাসিতে ম্লান হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘এই প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়। সত্যি বলতে, শুরুতে আমিও খুব অবাক হয়েছি। পরে ছবি তুলতে তুলতে বুঝেছি, আমরা খেয়াল করি না বলেই টের পাই না, কত প্রজাতির পোকার আনাগোনা থাকে বাগানে। চলুন আপনাকে দেখাই…’
আমাকে তাঁর শখের বাগানে নিয়ে যান আশিফুল হক। পাঁচতলা বাসার একদম ওপরের তলায় ব্যাংকার স্ত্রী সামিয়া আহমেদের সঙ্গে থাকেন তিনি। রুমের সামনেই খোলা বারান্দাটাকে একচিলতে উঠানও বলা যায়। সেখানে নানা জাতের গাছ। ছাদ থেকেও গাছের ডাল, লতাপাতা এসে ঝুলে আছে। আতা, আখ, বাঁশ, ঘৃতকুমারী, লেবু, আমলকী, নয়নতারাসহ নানা জাতের ফল, ফুল, সবজি, ঘাস বাগানটাকে সবুজ করে তুলেছে। আশিফুল নিজেই পরিচর্যা করেন।
বাগানের এক পাশে কয়েকটি আখগাছ। সেখানে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে একটি পাতা ধরেন আশিফুল। ইশারায় পাতাটা দেখিয়ে বলেন, ‘এই যে দেখুন, একটা প্ল্যান্ট হপার বসে আছে।’ এগিয়ে গিয়ে দেখি, সাদাটে একটা গাছফড়িং আখের পাতায় সন্তর্পণে বসে আছে। পাশের আরেকটা পাতা টেনে দেখালেন, ডিম পেড়েছে ক্ষুদ্রকায় আরেকটা পোকা। খালি চোখে এটুকু দেখেই যখন আমি মুগ্ধ, আশিফুল হক তখন পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে ক্যামেরায় ম্যাক্রো লেন্স লাগিয়ে নেন। তারপর কায়দা করে পোকাটাকে ফেলেন ক্যামেরার নিচে। কয়েক গুণ বড় হয়ে পর্দায় উন্মোচিত হয় তার ভিন্ন রূপ। অপূর্ব তার গায়ের রং, পা নাড়াচ্ছে, পিটপিট করছে চোখ, কিছু একটা মুখে পুরে খাচ্ছে—মুগ্ধ করে ক্ষুদ্র পোকাটার জীবনযাপন। এই মুগ্ধতাই আশিফুল হকের ছবি তোলার প্রেরণা।
ঢাকার কাঁঠালবাগানে আশিফুল হকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কয়েক বছর আগে খিলগাঁওয়ের রিয়াজবাগের এই বাসায় এসেছেন। নিজেদেরই বাসা। এখানে আসার পরই বাগানের শখ হয়। সেই বাগানে নানা জাতের গাছ আনেন। বাড়ে পাখপাখালির আনাগোনা। তখন বাসায় বসে মাঝেমধ্যে ডিএসএলআরে পাখির ছবি তুলতেন। সেই ক্যামেরা নিয়েই একদিন জুম করে তুলে ফেলেন একটা পিঁপড়ার ছবি। পেটমোটা পিঁপড়াটার গায়ের লাল রং, অদ্ভুত শারীরিক গঠন আশিফুলকে মুগ্ধ করে। সব সময়ের চেনা একটা পিঁপড়াই যখন এত সুন্দর, অন্য কীটপতঙ্গ না জানি আরও কত সুন্দর। ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যান বাগানে। একবার গুবরে পোকার ছবি তোলেন তো আরেকবার মাছি-মাকড়সার।
ঘোর করোনাকাল তখন। বাসাতেই থাকেন দুজন। ভোরে উঠে নামাজ পড়ে গাছের যত্নআত্তি করেন আশিফুল। এরপর লেগে পড়েন ছবি তুলতে। দিনে দিনে নেশাটা তাঁকে পেয়ে বসে। ইন্টারনেট ঘেঁটে ছবির পোকা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। কীভাবে কীটপতঙ্গের ছবি আরও ভালো করে তোলা যায়, জানার চেষ্টা করেন। জানতে পারেন, ডিএসএলআরের চেয়ে মুঠোফোনের ক্যামেরায় ম্যাক্রো লেন্স লাগিয়েই মানসম্পন্ন ছবি তোলা যায়। এক মাসের মধ্যেই কিনে ফেলেন সেই ম্যাক্রো লেন্স। তারপর শুধু ছবি তোলা।
মাস ঘুরতে না ঘুরতে বেশ কয়েক প্রজাতির কীটপতঙ্গের ছবি তুলে ফেলেন আশিফুল হক। কিন্তু ছবিগুলো তুলে শুধু নিজের কম্পিউটারে রেখে লাভ কী! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও খুব একটা সক্রিয় নন তিনি। তাহলে কী করবেন? তখন উপায় বাতলে দেন যুক্তরাষ্ট্রের এক অধ্যাপক। পোকামাকড় নিয়েই মেইলে যাঁর সঙ্গে আশিফুলের যোগাযোগ। তিনিই ‘আই ন্যাচারালিস্ট’-এ যুক্ত হতে পরামর্শ দেন। এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকৃতিবাদী, নাগরিক বিজ্ঞানী আর জীববিজ্ঞানীদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক সামাজিক নেটওয়ার্ক। ওয়েবসাইটে নিজের নামে একটি পেজ খোলেন আশিফুল হক। তাঁর তোলা সব কীটপতঙ্গের ছবি তথ্যসহ এখানে তুলে দিতে থাকেন। যেসব কীটপতঙ্গ সম্পর্কে তথ্য খুঁজে পান না, ‘আননোন’ হিসেবে ওয়েবসাইটে তুলে দেন। নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা সঙ্গে সঙ্গেই তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। আই ন্যাচারালিস্টে এখন আশিফুল হকের তোলা এক হাজারের বেশি কীটপতঙ্গের ছবি আছে। এসব ছবির প্রজাতির সংখ্যা তারা বলছে ২৭৪। এর মধ্যে মাকড়সাই আছে অর্ধশতাধিক। এ ছাড়া আছে ফড়িং, হপার, অ্যাফিড, পিঁপড়া, মৌমাছি, বোলতা, করাতি পোকা, মথ, প্রজাপতি, ঝিঁঝি পোকা, বিছা, কেন্নোর মতো কীটপতঙ্গ।
আশিফুল বলেন, ‘মাকড়সার ছবি তুলতে আমি বেশি পছন্দ করি। কিছু কিছু মাকড়সার রং এত সুন্দর! অদ্ভুত তাদের গায়ের রং, অদ্ভুত টেক্সচার। আমি রং পছন্দ করি। রঙিন জিনিসের প্রতি আমার আলাদা টান আছে। খুব ভালো লাগে রঙিন পোকা দেখতে।’
আশিফুল হক মৃত্তিকাবিজ্ঞানে স্নাতক। পেশা হিসেবে পৈতৃক ব্যবসাকেই বেছে নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জীববিজ্ঞানের বন্ধুদের প্রাণী-কীটপতঙ্গ নিয়ে কাজ করতে দেখলে মশকরা করতেন। এখন নিজেই সেই কাজে আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন।
আশিফুল হক চান, আরও মানুষ পোকামাকড়ের ছবি তুলতে আগ্রহী হোক। দেশে অনেক বিষয়ে আলোকচিত্রী আছেন। কিন্তু কীটপ্রতঙ্গের ছবি তোলেন খুব কম মানুষই। আশিফুল হক বলেন, ‘আমি বিশেষজ্ঞ নই। ছবি তুলি শখ করে। আমার ছবিগুলো কারও কাজে লাগলে আনন্দিত হব।’