বিষণ্নতার সঙ্গে অর্থের কোনো সম্পর্ক আছে কি

অনেক মানুষই আছে জীবনের সব অপূর্ণতার জন্য টাকার অভাবকেই দায়ী করে থাকেন। মনে করেন, টাকা থাকলেই সব আনন্দ আর সুখ কেনা সম্ভব। কিন্তু সত্যিই কি টাকা থাকলে সব হয়? কিংবা পেশাগত সাফল্যই কি সুখের মাপকাঠি?

সাফল্যের শীর্ষে থাকা ব্যক্তি কিংবা অঢেল সম্পদের মালিকমাত্রই সুখী, কখনোই তাঁরা বিষণ্নতায় ভোগেন না, এ ধারণার আদতে কোনো ভিত্তি নেই। সুখী মানুষের জামার গল্পটা মনে আছে তো? রাজার অসুখ ভালো করার জন্য যখন সুখী মানুষের জামার প্রয়োজন হলো, তখন দেখা গেল, ভীষণ অভাবী একজন মানুষই কেবল নিজেকে সুখী ভাবছেন। অনেক সম্পদের মালিক হয়েও অন্যরা ‘সুখী’ নন। বাস্তবের সঙ্গে এ গল্পের দারুণ মিল। গোটা পৃথিবীর সামনে আপাতদৃষ্টে যাঁরা ‘সফল’ কিংবা ‘বিত্তবান’, বিষণ্নতায় ভোগেন তাঁরাও। কিন্তু কেন?

টাকা থাকলেই কি সব হয়

সুখ আসলে ভীষণ আপেক্ষিক একটি বিষয়। কেউ হয়তো পথের ধারে এক প্লেট ফুচকা খেয়েই সুখ অনুভব করেন, কেউ আবার পাঁচ তারকা হোটেলের বুফে খেয়েও পরিতৃপ্ত হতে পারেন না। জীবনটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন, তার ওপরই নির্ভর করে আপনি ঠিক কতটা সুখী। সম্পদ ও সাফল্য অর্জন করেও একজন মানুষ নানা কারণেই বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন। কেউ স্বাস্থ্য নিয়ে অসুখী হতে পারেন, কেউ ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্কে অসুখী হতে পারেন, কেউ আবার অপূর্ণ কোনো স্বপ্নের হাতছানি ভুলতে পারেন না। এমনটাই বলছিলেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী শারমিন হক।

স্বাস্থ্যই সম্পদ

নিজের কিংবা আপনজনের অসুস্থতা একজন সফল ব্যক্তির বিষণ্নতার অন্যতম কারণ। সুস্থ ও স্বাভাবিক একজন মানুষের মতো জীবন যাপন করতে না পারাটা সত্যিই কষ্টের। নির্দিষ্ট কিছু অসুখে ভুগলে খাওয়াদাওয়া করতে হয় খুব বেছে বেছে। ঘরভর্তি সুস্বাদু খাবার, অথচ তিনি কিংবা তাঁর খুব কাছের কেউ একজন সেসবের স্বাদ নিতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে হতাশা তো আসতেই পারে। সাফল্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজের প্রতি অবহেলাও করেন অনেকেই, সাফল্যের সিঁড়ি বাইতে বাইতে খুইয়ে ফেলেন ‘স্বাস্থ্য’ নামের এক অমূল্য সম্পদ।

অসুস্থতা একজন সফল ব্যক্তির বিষণ্নতার অন্যতম কারণ

সম্পর্কের খুঁটিনাটি

সাফল্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে আলগা হয়ে যেতে পারে সম্পর্কের বন্ধন। জীবনসঙ্গী, সন্তান কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ মা-বাবা হয়তো দিনের পর দিন তাঁকে কাছে পাননি। তাতে তাঁদের কেউ কেউ নিজেকে ‘অবহেলা’র শিকারও মনে করতে পারেন। ‘সফল’ ব্যক্তিটি যখন আবিষ্কার করেন, অমূল্য এই সম্পর্কগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে, যাবতীয় সাফল্যকেই তখন তাঁর মনে হতে পারে অর্থহীন। একই ঘটনা ঘটতে পারে, যদি তিনি ‘সফল’ হয়ে ওঠার আগেই আপনজনদের কেউ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাঁর ব্যস্ততায়, তাঁর নজরদারির অভাবে সন্তান বিপথগামী হয়ে গেলেও বিষণ্নতা গ্রাস করতে পারে তাঁকে। আবার দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার ফলে জীবনসঙ্গীও অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এমন কিছু ঘটে থাকলে সাফল্যের চূড়ায় থাকলেও জীবনের সুখটুকু হারিয়ে ফেলাই স্বাভাবিক। কেউ কেউ আবার আবিষ্কার করতে পারেন, তাঁর ‘বন্ধু’রা আসলে তাঁর সম্পদ বা ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতেই ব্যস্ত। তাঁর জন্য তাঁদের তেমন কোনো টান নেই কিংবা আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে তাঁর একটা বিশাল দূরত্ব। তাঁদের মধ্যেও হয়তো স্বার্থান্বেষী মানুষের সংখ্যা কম নয়। তিনি কখনো বিপদে পড়লে পাশে এসে দাঁড়াবেন, এমন মানুষের সংখ্যা হয়তো খুব কম। সম্পর্কের এমন নানা সংঘাতেই অশান্তির আবির্ভাব হতে পারে একজন সফল ব্যক্তির জীবনে।

প্রত্যাশার পারদ চড়তে চড়তে অসীমে পৌঁছে গেলেও কিন্তু মুশকিল

প্রত্যাশার অপূর্ণতা

প্রত্যাশার পারদ চড়তে চড়তে অসীমে পৌঁছে গেলেও কিন্তু মুশকিল। ‘চাই, চাই, আরও চাই’—এই চক্রের শেষ নেই। এই চাওয়া মেটানো দুষ্কর। একটা না একটা অপূর্ণতা থেকেই যায় আজীবন। অবশ্য অর্থের চাহিদা ছাড়াও জীবনে থাকে আরও নানাবিধ চাহিদা। হয়তো নিজে এক পেশায় যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে অন্য পেশায় গিয়েছেন। ‘সফল’ও হয়েছেন। কিন্তু এমনও হতে পারে, তাঁর এই সাফল্যের ঔজ্জ্বল্য হয়তো তাঁর অন্তরের মাঝখানে একরাশ বিষণ্নতার ছায়া দিয়ে জড়ানো, নিজের আয়নায় তিনি একেবারেই ম্রিয়মাণ।