এক ব্যাচে ছিলেন ৫০ জন, ৯ জনই এখন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ ব্যাচে শিক্ষার্থী ছিলেন ৫০ জন। তাঁদের মধ্যে ৯ জন স্নাতকোত্তর শেষ করেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

স্নাতকোত্তরের পরপরই তাঁরা সবাই শিক্ষক হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়ে গেছেন
কোলাজ: প্রথম আলো

‘বেয়াড়া ব্যাচ’ হিসেবে আলাদা একটা পরিচিতি চতুর্থ ব্যাচের আগে থেকেই ছিল। পড়াশোনার ব্যাপারে তাঁরা নাকি ‘সিরিয়াস’ নন। এ নিয়ে শিক্ষকেরাও বিভিন্ন সময় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মজার বিষয় হলো, স্নাতকোত্তরের ৬ মাসের মধ্যেই এ ব্যাচের ৯ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ইংরেজি বিভাগের এই প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা হলেন সায়মা ইয়াসমিন, ফাহিম আহমেদ, আসিফ চৌধুরী, তোহফা মাহানূর, সাদিয়া জামান, নাফিসা নাহরিন, রিদ্ওয়ানা ইসলাম, রাগিব মেহফুজ ও শাহজালাল সিদ্দীক। তাঁদের মধ্যে রিদ্ওয়ানা শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে, নাফিসা নর্দান ইউনিভার্সিটিতে, তোহফা মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে, রাগিব ও শাহজালাল হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফাহিম উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে, সাদিয়া সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটিতে, সায়মা প্রাইম ইউনিভার্সিটিতে ও আসিফ আরটিএম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিয়েছেন।

কারও বাবা, কারও-বা মা ছিলেন শিক্ষক। মা-বাবাকে দেখে, কেউ-বা টিউশনি করাতে গিয়ে শিক্ষকতার প্রেমে পড়েছেন। ভিন্ন গল্পও আছে। সায়মা যেমন জানালেন, ছোটবেলায় কোনো এক অদ্ভুত কারণে তিনি দরজি হতে চাইতেন। বাস্তববুদ্ধি হওয়ার পর চাইতেন ডাক্তার হতে। আর শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছাটা সাম্প্রতিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বন্ধুদের উৎসাহে আগ্রহী হয়েছিলেন।

শিক্ষক হয়ে ওঠার পথটা সব সময় সহজ ছিল না। ফাহিম বলছিলেন, ‘বিইউপিতে ইংরেজি বিভাগে পড়া নিয়ে পরিবারের অনেকেই অখুশি ছিলেন। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই, নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই বহন করব। সেই থেকে টিউশনি, কোচিং করিয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করেছি। অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। কারণ, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বিইউপির টিউশন ফি অনেক বেশি।’

শিক্ষক হতে চাইলে সবার আগে নিশ্চয়ই দরকার ভালো ফল। সিলেটের আরটিএম আল–কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রভাষক আসিফ অবশ্য বললেন ভিন্ন কথা, ‘সব সময় ভালো ছাত্রই যে ভালো শিক্ষক হবে, তেমনটা মনে করি না। আমি মাঝারি মানের ছাত্র। আমি বলব, যাঁদের ফল মোটামুটি ভালো, তাঁরাও আগ্রহ থাকলে শিক্ষকতায় আসতে পারেন। নেতৃত্ব, উপস্থাপনের দক্ষতা, মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার গুণাবলি আপনাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে।’ একমত সাদিয়াও। তাঁর বক্তব্য, ‘শিক্ষকতা এমন একটি পেশা, যেখানে একাডেমিক ফলের পাশাপাশি দরকার নৈতিক গুণাবলি, উপস্থাপন, বন্ধুসুলভ আচরণ ও সাংগঠনিকভাবে কাজ করার মানসিকতা।’

হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য নিযুক্ত প্রভাষক শাহজালাল সিদ্দীকের যেমন স্নাতক প্রথম বর্ষে সিজিপিএ ছিল ১ দশমিক ৯। বিশেষ বিবেচনায় পরের বর্ষে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আশপাশের মানুষ বলতে শুরু করেছিল, ‘আগামী চার-পাঁচ বছরেও এই ছেলে পড়ালেখা শেষ করতে পারবে না।’ ঠিক তখনই তিনি পড়ালেখার প্রতি ‘সিরিয়াস’ হন। স্নাতক শেষ করেন ৩ দশমিক ১৬ সিজিপিএ নিয়ে। স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ছিল আরও ভালো, ৩ দশমিক ৮২।

আলাপের একপর্যায়ে তরুণ শিক্ষকেরা তাঁদের সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা শোনালেন। সায়মা বলেন, ‘মৌখিক পরীক্ষার আগের দিন রাত জেগে প্রস্তুতি নিয়ে সকালে অফিসে গিয়েছি। অফিস থেকে দুই ঘণ্টার ছুটি নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। ভাইভা বোর্ড থেকে বেরিয়ে আবার অফিসে এসেছি। নিজেকে রিলে রেসের ঘোড়া মনে হচ্ছিল। ইন্টারভিউতে আমি টিচার্স পোর্টফোলিও তৈরি করেছিলাম, যা অন্য প্রার্থীদের ছিল না। বোর্ডের সদস্যরা খুব আন্তরিক ছিলেন। আমার জন্মস্থান নোয়াখালী জানার পর এক বোর্ড মেম্বার আমাকে বাংলা সিনেমার একটি গানের দুটি লাইন গেয়েও শোনালেন।’ ফাহিম বললেন, ‘স্নাতকোত্তর পরীক্ষার দুই সপ্তাহ আগে সড়ক দুর্ঘটনায় আমার পা ভেঙে যায়। এ অবস্থায়ই ইন্টারভিউয়ে অংশ নিই। লাঠি নিয়ে হাঁটতে হচ্ছিল। তখন ভাইভা বোর্ডের একজন সিনিয়র শিক্ষক বলছিলেন, “লাঠি হাতে তোমার মধ্যে বেশ রাজকীয় একটা ভাব এসেছে।”’

নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছাতে চান এই শিক্ষকেরা। তাই ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চান। এ সম্পর্কে নাফিসা যোগ করলেন, ‘শিক্ষকদেরও শিক্ষার শেষ নেই। নিজের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য আরও পড়াশোনা করতে চাই। কয়েক বছরের মধ্যেই পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার এবং গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।’ তোহফা জানালেন, পিএইচডি গবেষক ছাড়াও ভবিষ্যতে লেখক ও তাত্ত্বিক (থিওরিস্ট) হতে চান তিনি।