‘শুধু প্রেম করব, বিয়ে না’

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

প্রশ্ন: আমরা দুই বিপরীত ধর্ম ও জাতের মানুষ। দুজনই অনার্স পাস এবং চাকরিপ্রত্যাশী। ষষ্ঠ–আষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমরা এক স্কুলে পড়াশোনা করি, সে হিসেবে চেনাজানা ছিল। তবে স্কুলজীবনে কখনো কথা হয়নি। পরে ২০২১ সালে ফেসবুকে বন্ধু হই, তখন টুকটাক কথা হতো। আর গত বছরের জুন মাস থেকে ঘনিষ্ঠ হতে থাকি। আমরা দুজনই আমাদের মধ্যকার ধর্মীয় বাধার বিষয়টি খুব ভালো করে জানতাম। তাই প্রেমে না জড়াতে দুজনই সতর্ক ছিলাম। এভাবে চলতে চলতে একসময় আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকি। একদিন আমি ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিই। সে প্রথমে না করলেও ধীরে ধীরে আমাদের প্রেম হয়ে যায়। তখন আমরা ঠিক করি, শুধু প্রেম করব, বিয়ে না। কেননা সমাজ আমাদের বিয়ে মেনে নেবে না। দিনে দিনে প্রেম গভীর হতে শুরু করে, আমরা বিয়ের বিষয়ে ভাবতে থাকি। নানা রকম স্বপ্ন সাজাই। কে কীভাবে পরিবারকে বলব, পরামর্শ করি।

কিন্তু এখন আমি মেয়েটির কাছ থেকে নিজেকে সরাতে চাই। কেননা আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে আমাদের সমাজ, ধর্ম এসব মেনে নেবে না। মেয়েটি খ্রিষ্টান, বিয়ে করতে হলে তাঁকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মে আসতে হবে। তাঁর পরিবার এটা মানবে না। আর আমাদের পরিবারও যে ধর্ম পরিবর্তন করলেই মেয়েটিকে মেনে নেবে, এমন না। কারণ, মেয়েটি গারো। আমার পরিবার অনেক রক্ষণশীল। উচ্চশিক্ষিত হয়েও নিজেদের আবেগ আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি, প্রেম করেছি। এখনো দুজনে আলোচনা করি, আমরা ভুল করছি, কিন্তু এরপরও কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারছি না। কথা না হলে সারা দিনের কাজকর্ম আমাদের কিছুই ঠিক চলে না। আর আমি এক দিন কথা না বললেই মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়ে, আত্মহত্যার কথা ভাবে, খাওয়া ছেড়ে দেয়। এমন অবস্থায় আমরা কী করতে পারি?

নীহার (ছদ্মনাম), ময়মনসিংহ সদর।

উত্তর: এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে তোমরা দুজন খুব সুন্দর মন নিয়ে বন্ধুত্ব শুরু করে ধীরে ধীরে অজান্তেই রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে গেছ। দুজনই মনের যৌক্তিক সত্তা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলে যে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী পরস্পরের জীবনসঙ্গী হওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বাধা আছে। এরপরও আবেগের কাছে দুজনই হেরে গেছ এবং পরিণতি জেনেও এগিয়ে গেছ।

শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে কিন্তু আবেগ মোকাবিলার ক্ষমতা নির্ভর করে না। লেখাপড়া শেখার ফলে জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হয়, তাতে বুদ্ধিমত্তার বিকাশও ঘটে। তবে তার সঙ্গে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাও যে একইভাবে বাড়বে, তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, আবেগ এবং যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার কাজটা মস্তিষ্কের দুটি আলাদা কেন্দ্রের মাধ্যমে ঘটে থাকে। আর এ কারণেই অনেক সতর্ক থাকা সত্ত্বেও কখন যে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছ, বুঝতেও পারোনি। তবে প্রেমের প্রস্তাবটি কিন্তু প্রথমে তুমিই ওকে দিয়েছিলে এবং মেয়েটি প্রথমে মানাও করেছিল। সেই সময়ে আবেগের কাছে পরাজিত না হয়ে তোমরা যদি পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করতে, তাহলে খুব ভালো হতো। বদলে তোমরা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলে, বাস্তবে যা মেনে চলাটা খুব কঠিন। অর্থাৎ দুজনে শুধু প্রেম করবে কিন্তু বিয়ে করবে না। খুব সম্ভবত এরপর তোমরা শারীরিক সম্পর্কেও জড়িয়েছ, যা তোমাদের বিবাহিত জীবনযাপ‌নের স্বপ্ন দেখার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরপর তোমরা নিজেদের পরিবারকে কীভাবে ম্যানেজ করবে, সেই পরিকল্পনাও করতে শুরু করো।

এই পর্যায়ে এসে তোমার কাছে বিষয়টি হয়তো খুব কঠিন মনে হতে শুরু করে। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তোমার মনে হয়, নিজেকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে ফেলাই ভালো। কারণ, মেয়েটি ধর্মান্তরিত হলে পরিবার ওর সঙ্গে অত্যন্ত নেতিবাচক আচরণ করবে। এ ছাড়া তোমার ক্ষেত্রে যা ঘটতে পারে, তা হলো মেয়েটি শুধু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেই হবে না। ওর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটিও তোমার পরিবার না–ও মেনে নিতে পারে। তুমি কি ভালো করে ভেবে দেখেছ, দুজনের মধ্যে কে বেশি বিপদে পড়বে? মেয়েটি প্রথম পর্যায়েই এই সম্পর্কটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়নি, হয়তো এই মনে করে যে তোমাদের পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে ও হয়তো বিপদে পড়তে হতে পারে। এটির পূর্বাভাস সে আগেই পেয়েছিল। এই সব কটি বিষয় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও সম্পর্কটি ধীরে ধীরে আরও নিবিড় হয়েছে।

পরিবারের কথা বাদ দাও, তোমার কথা বলো। ওর ধর্ম পরিচয়, নাকি ওর জাতি পরিচয়—কোনটা তোমাকে বেশি বিচলিত করছে? যদি সে ধর্মান্তরিত হয়ও, তাহলে কি স্ত্রী হিসেবে ওকে মর্যাদা দিতে এবং তোমার পরিবারে ওর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে তুমি সব রকম উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে পারবে? যেহেতু আমরা একটি পুরুষশাসিত সমাজে বাস করছি, তাই মেয়েদের কাছে প্রত্যাশা করা হয় যে সে তার শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করবে এবং সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় বিয়ের পর সবার মন জয় করবে। তার ওপরে সে যদি ধর্মান্তরিত হয়ে আসে এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সদস্য হয়, তাহলে তার অগ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সমাজের একজন সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ হিসেবে বিয়ের মতো বড় পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই তুমি যদি নিজের পরিবারে তার জন্য যথেষ্ট শ্রদ্ধা তৈরিতে পদক্ষেপ নিতে অক্ষম হও এবং এতটা মানসিক চাপ নিতে অপারগ হও, তাহলে মেয়েটি কষ্ট পেলেও ওকে খুব সুন্দরভাবে নিজের অক্ষমতার বিষয়টি তুলে ধরো।

সে যদি নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো ভয়ংকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা চিন্তা করে, তাহলে জিজ্ঞেস করো, ও কোনো মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারীর কাছে কিছুদিন ধারাবাহিকভাবে সেবা গ্রহণ করে নিজের মনের শক্তি বাড়াতে চায় কি না। যদি সে আগ্রহী থাকে, তাহলে জাতীয় ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারে গিয়ে বিনা মূল্যে সেবা গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার রয়েছে, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা (কাউন্সেলিং) দেওয়ার জন্য ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা কাজ করছেন। মেয়েটি যদি একেবারেই আগ্রহী না হয়, তাহলে ওর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাও। কারণ, তোমাদের এই সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তোমার অগ্রণী ভূমিকা ছিল।

ঘোষণা

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA