নিকোল কিডম্যান
নিকোল কিডম্যান

বন্ধুদের বাড়ির মেঝেতে, সোফায় ঘুমিয়ে রাত কাটিয়েছেন এই অস্কারজয়ী অভিনেত্রী

গোল্ডেন গ্লোব, ব্রিটিশ একাডেমি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, প্রাইমটাইম এমি অ্যাওয়ার্ড, অস্কার—কী নেই তাঁর ঝুলিতে! হলিউড অভিনেত্রী নিকোল কিডম্যান এ বছর পেয়েছেন এএফআই লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডও। অনুষ্ঠানে যে বক্তৃতা তিনি দিয়েছেন, তা হয়তো আপনাকেও অনুপ্রেরণা দেবে।

ধন্যবাদ আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট (এএফআই)।

আজ এই আলো ঝলমলে হলরুমে আসার পথটা শুরু হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া থেকে, আমার বোনকে সঙ্গে নিয়ে। সে-ও আছে আজ দর্শকের আসনে। জন্মের পর থেকে মা-বাবা সব সময় তা-ই হতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, যা আমরা হতে চেয়েছি। বলেছেন, যা ইচ্ছে করো, যা ইচ্ছে শোনো। অতএব আমি বেছে নিয়েছিলাম স্থানীয় মঞ্চনাটক।

আরও একটা অপার স্বাধীনতা বাড়ি থেকে পেয়েছিলাম, বই পড়ার স্বাধীনতা। মা-বাবা বলেই দিয়েছিলেন—যা ইচ্ছে পড়ো। যেহেতু মঞ্চে কাজ শুরু করেছি একদম ছোটবেলায়, অনেক সময় পারিশ্রমিক হিসেবেও বই পেয়েছি। এতই ছোট ছিলাম যে নাটকের পারিশ্রমিক হিসেবে আমার হাতে টাকা তুলে দেওয়াটা ঠিক শোভন দেখাত না। চেখভ, ইবসেনের বই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় পারিশ্রমিক।

আজও পারিশ্রমিক হিসেবে বই পেতে বোধ হয় মন্দ লাগবে না। না থাক…আমি বরং চেক ভাঙিয়ে বই কিনে নেব (হাসি)। এখন মনে হয়, ছোটবেলায় স্বাধীনতা বোধ হয় একটু বেশিই পেয়ে গিয়েছিলাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখা শুরু করেছিলাম। বাচ্চারা, তোমরা কিন্তু এ কাজ কোরো না। এমন বহু সিনেমাও তখন দেখেছি, যা হয়তো আমার দেখার কথা ছিল না। সিনেমা হল হয়ে উঠেছিল আমার ক্লাসরুম।

ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়াই ১৪ বছর বয়সে। জেন ক্যাম্পিয়ন নামে এক নারী আমার কাছে এসেছিলেন। তিনিও তখন মাত্রই শুরু করেছেন। স্থানীয় নাট্যদলগুলোতে তিনি অভিনয়শিল্পী খুঁজছিলেন। দেখা করে তিনি বললেন, আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে আমি তোমাকে চাই। কিন্তু চিত্রনাট্য পড়ে সোজাসাপটা বলে দিলাম, ‘পছন্দ হয়নি।’ মানুষ হিসেবে জেন ছিলেন অসাধারণ। হেসে তিনি বলেছিলেন, ‘কিন্তু আমরা তো বন্ধু হতে পারি।’

নিকোল কিডম্যান

জন্মসূত্রে আমি মার্কিনি, বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ায়। আজীবন পৃথিবী চষে বেড়াতে চেয়েছি। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য অভিনয়ের চেয়ে ভালো পেশা আর হয় না। অভিনয়শিল্পীর জীবন মানে যাযাবরের জীবন। যেখানে কাজ, যেখানে সুযোগ, যেখানে জীবিকার সন্ধান, সেখানেই ছুটতে হয়। আমার খুব সৌভাগ্য, যুক্তরাষ্ট্রে পা রেখেছিলাম। হাতে কিছু কাজ ছিল। পাশাপাশি চলচ্চিত্রের জন্য অডিশনও দিচ্ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার জায়গা ছিল না। বন্ধুদের বাড়ির মেঝেতে বা সোফায় ঘুমিয়ে রাত কাটিয়েছি। ক্যাব ভাড়া করাটা ভীষণ খরুচে মনে হতো। তাই অডিশনের ডাক এলেও আগে খুঁজতে শুরু করতাম, কোনো বন্ধু কি ওই পথে যাবে, যার গাড়িতে সওয়ার হয়ে যেতে পারি? আমার কাছে ক্যাবে করে অডিশনে যাওয়া মানেই ছিল রাতের খাবার না খেয়ে থাকা। সেই সব বন্ধুদের ধন্যবাদ, যাঁরা সেই সময়টাতে আমার পাশে ছিলেন। তাঁদের অনেকে আজ এই হলরুমেও আছেন।

নিকোল কিডম্যান

যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখার পর দ্রুতই আমার পরিচয় হয়েছিল পরিচালক, প্রযোজক আর অভিনয়শিল্পী, অর্থাৎ নিজের গোত্রের মানুষজনের সঙ্গে। একেকজনের কাজ দেখতাম, আর বিস্মিত হতাম। অভিনয়শিল্পীদের জীবনটাই এমন—সতীর্থদের কারও সঙ্গে জীবনে দেখাই হবে একবার, কেউ কেউ হয়ে উঠবে কাছের বন্ধু, কেউ হবে সমর্থক। কাউকে আপনি ভালোবেসে ফেলবেন, কাউকে হয়তো বিয়েও করবেন, কারও সঙ্গে দেখা হবে না বছরের পর বছর, কারও সঙ্গে হয়তো দেখা হবে শুধুই ফিল্মের সেটে। একেই তো বলে যাযাবরের জীবন। আমি সৌভাগ্যবান, এই জীবনটা আমার হয়েছে।

অসাধারণ সব অভিনয়শিল্পী, পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছি, শিখেছি। পর্দায় এমন সব নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছি, যাঁদের আমরা সচরাচর আশপাশে দেখি না। এটাও আমার জন্য একটা বড় পাওয়া। সেই নির্মাতাদের ধন্যবাদ, যাঁরা এত অসাধারণ চরিত্রগুলো আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। হোক অস্থায়ী, তবুও তো এই পৃথিবীতে আপনারাই আমাকে একটা জায়গা করে দিয়েছেন। আমার জীবনে বহু কিছু পেয়েছি ভাগ্যের জোরে, তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে যেটা উল্লেখযোগ্য, তা হলো ভালোবাসা। অনেক, অনেক ভালোবাসা।

পরিচালক অ্যান্ডি ওয়ারহল একবার একটা দারুণ কথা বলেছিলেন, ‘শিল্পের চর্চা করুন। ভালো হলো না খারাপ হলো, সেই সিদ্ধান্ত অন্যকে নিতে দিন এবং অন্যেরা সিদ্ধান্ত নিতে নিতে আপনি আরও কিছু কাজ করে ফেলুন।’ আমিও সেটাই করতে চাই।