ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই। এই ৭৮ বছরে বহু তরুণ–তরুণীর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এই প্রাঙ্গণে। তাঁদের প্রতিনিধি হয়েই লিখেছেন ডা. রাফিয়া আলম
মফস্সলে বেড়ে ওঠা মধ্যবিত্তের সন্তান হিসেবে জীবনের স্বপ্নই ছিল সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাওয়া। একজন অগ্রজের কাছে শুনেছিলাম, ‘এই কয়েকটা দিন কষ্ট করলেই জীবন বদলে যাবে।’ জীবন সত্যিই বদলেছে। বদলেছে স্বপ্নের ধরনও। ‘কয়েকটা দিন’ অর্থাৎ, ভর্তি পরীক্ষার আগের সময়টা ভীষণ কষ্ট করেছিলাম। মেঘের ভেলায় মন ভাসিয়ে বড় হওয়া এই আমি ‘পড়ুয়া’ ছিলাম না কখনোই। বরং ছিলাম ঘুমকাতুরে। সেরা শিক্ষার্থীর ‘তকমা’ পাইনি স্কুল-কলেজে। যেকোনো সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেলেই জীবন ধন্য—ভাবখানা তখন এমনই। তবে মনের গোপনতম কোণে, এই পৃথিবীর সবার চোখের আড়ালে ছিল দুঃসাহসী এক স্বপ্ন—ঢাকা মেডিকেল কলেজ। এই ফাঁকে বলে রাখি, চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নটি আসলে আমার বাবার। আমি তাঁর স্বপ্নপূরণের কান্ডারি।
ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর নিজের চোখ-কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ—নামটার মধ্যেই তো কেমন শিহরণ! তবে জীবনের বাস্তবতার সঙ্গেও পরিচয় হলো সেই ধাক্কাতেই। কাছের এক ‘বন্ধু’ কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজেই সুযোগ পায়নি, আমার সঙ্গে তাই যোগাযোগ বন্ধ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম দিনগুলোতে একাকিত্বই হয়েছিল সঙ্গী। অনেক শিক্ষার্থীই এসেছে ঢাকার বাইরে থেকে, কিন্তু পূর্বপরিচিত কেউ নেই। নতুন জীবনে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে নিয়েই পথচলার শুরু। তবে ওই সময়টায় আমার মনে হতো, আমি ভীষণ একা। সবাই পড়ছে, জটিল বিষয়গুলো আয়ত্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি পারছি না। মানুষের শরীর নিয়ে পড়ালেখা কি আর চাট্টিখানি কথা! উৎকট, ঝাঁজালো গন্ধে অ্যানাটমি ডিসেকশন হলে রাখা মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হাতে নিয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের ‘ধাক্কা’টা সামলাতে পারছিলাম না। সপ্তাহখানেকের মাথায়ই বলেছিলাম, মেডিকেল কলেজে আর যাব না। মা বুঝিয়ে-শুনিয়ে আবার নিয়ে চললেন আমায়। আমার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থীই অবশ্য মেডিকেল কলেজের প্রথম দিনগুলোয় নানা মুশকিলে পড়েছেন, ইতিহাস তেমনটাই বলে।
প্রথম বর্ষে ‘আইটেম’ নামের ছোট্ট পরীক্ষাটাই জগদ্দল পাথরের মতো ভারী মনে হয়েছিল। কী কঠিন সব ব্যাপার–স্যাপারই না বুঝতে হয়েছে! একলা এই ভার বয়ে চলা অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই কঠিন। তাই চলে ‘গ্রুপ স্টাডি’। কিন্তু আমার মতো ভিন্নধারার চিন্তাচেতনার মানুষ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হতাশার সাগরে ডুবতে যাচ্ছি, সেই মুহূর্তে বন্ধু হয়ে উঠল সহপাঠী তাসমি জ্যোতি। আমার মতো করে আমাকে বুঝতে শুরু করল। কীভাবে পড়লে পড়াটা সহজ হবে আমার জন্য, তা-ও বুঝতে পারত। পড়ালেখা, ঘোরাঘুরি, হালকা-পাতলা দুষ্টুমি—জীবনের রং ফিরে পেতে শুরু করল।
হোস্টেলের সামনে সাদা ফুল পড়ে থাকে বর্ষায়। শিক্ষার্থীদের পায়ে দলিত হওয়াই যেন ফুলেদের ভাগ্যলিখন। ভাবলাম, আমি তো আছি; আমিই না হয় কুড়িয়ে এনে বদলে দিলাম কয়েকটি ফুলের ভাগ্য। এই ক্যাম্পাসের কজন শিক্ষার্থী ভোরের শিউলি কুড়ানোর আনন্দ পেয়েছে? কজন দেখেছে কদম ফুলের সৌন্দর্য? আমি তো তবু সুযোগ করে নিয়েছি। জীবনের স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ কিংবা মানসিক অবস্থা অবশ্য এখানে থাকে না অধিকাংশেরই। হাসপাতালের ওয়ার্ডে নিয়ম করে যেতে শুরু করতে হয়েছিল তৃতীয় বর্ষ থেকে। প্রবেশদ্বারের কাছেই তীব্র গন্ধ এসে ধাক্কা দিত নাকে। যে পরিষ্কারক পদার্থ দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করা হয়, তার গন্ধটাই যে উৎকট! গরম, দুর্গন্ধ, ময়লা—এসবের মধ্যেই রোগীর বিছানা। ওয়ার্ড, বারান্দা, করিডর—কোথায় নেই রোগী?
রোগীর পুঁজ, রক্ত, মলমূত্র, বমি, কফ—এসব তো মেডিকেল–জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরও সঙ্গী হলো ভুক্তভোগী রোগীদের কষ্ট। একজন রোগীর শারীরিক কষ্ট আর মানসিক পীড়ার বাইরেও তাঁর পরিবার, এমনকি কিছু রোগের বিষয়ে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। সারা দেশ থেকে কত রকম রোগী কত জটিল পরিস্থিতিতে, কত অসহায় অবস্থায় চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন এখানে। এখানে রোগীও যেন শিক্ষক।
‘আইটেম’, ‘কার্ড’, ‘টার্ম’, পেশাগত পরীক্ষা—পাঁচটি বছর পেরিয়ে শিক্ষানবিশি জীবন। বিভিন্ন বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা; ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা; সেসবই তো পাথেয় হয়েছে এই জীবনে। রোগী এবং রোগীর স্বজনেরাও এই ক্যাম্পাসের প্রাণীদের প্রতি মমত্ব অনুভব করেন; টুকিটাকি খাবার দেন। নিজেদের বিপদের দিনেও ‘মালিকবিহীন’ এই প্রাণীদের প্রতি মানবিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে মানবতার শিক্ষাই দিয়ে চলেন এ দেশের ‘সাধারণ’ মানুষেরা। রোগীদের জীবনের বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে জীবনকে নতুন চোখে দেখা আর মানবিক স্বপ্ন দেখার দীক্ষা পেয়েছি এই ক্যাম্পাসে। আজও দেহমনে শিহরণ জাগানো এক নাম ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ’, যা আজীবন থাকবে ‘আমার’, ‘আমাদের’।