গত ১২ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়েছে মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।
আমার বড় ভাইটা মারা গেল একুশ বছর বয়সে। হঠাৎ দুই দিনের জ্বর, ডাক্তার কিছু বুঝে ওঠার আগেই...।
আমরা তখন রাঙামাটিতে। খবর পেয়ে ঢাকায় এলাম। এইচএসসির পর ভর্তি পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসেছিল ভাইয়া। ক্লাস এইটে ওর বড় একটা অপারেশন হয়। তারপর ভালোই ছিল। লেখাপড়ায় পিছিয়ে যায় শুধু। কিন্তু মৃত্যুটা এতটাই আকস্মিক যে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে গেলাম।
আমার বাবা ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। আমি গভীর ট্রমায় চলে গেলাম। পুরোটা ঘরে ভাইয়ার স্মৃতি, অথচ সে নেই, কিছুতেই এটা মানতে পারছিলাম না। ডাক্তার এসে বাবাকে বললেন, ‘মনিরুজ্জামান সাহেব, ঘর থেকে পলাশের (বড় ভাই) সব স্মৃতিচিহ্ন সরিয়ে ফেলুন, আর মেয়েকে চেঞ্জে নিয়ে যান। ওর সামনে মৃত্যুর কথাটা বলার দরকার নেই!’
জুলাইয়ে আমার এইচএসসি ফাইনাল, পরের মাসেই বোনটার এসএসসি। ছাত্রী হিসেবে সে ভালো, নিয়মিত পড়েছে, নোট করত, লিখত, রিভিশন দিত। কিন্তু ভাইয়ার হঠাৎ মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে গেল। জ্বরে পড়ল...মোটকথা পুরো পরিবার একটা প্রচণ্ড ঝড়ে ছিন্নভিন্ন যেন।
একমাত্র মাকে দেখলাম শক্ত আছেন। তিনি ছোট বোনকে বলেন, পলাশের খুব শখ ছিল তুমি স্টার মার্কস পাবে, চেষ্টা করো মা।
বোনটা এসএসসি দিল। তার আগে ওর চিকেন পক্স হলো, মোটামুটি অসুস্থতা নিয়েই পরীক্ষা শেষ করল।
রেজাল্টের দিন ওর সঙ্গে মা–ও গেলেন। নানাভাবে সবাই বোঝাচ্ছে, এত বড় একটা দুর্ঘটনা গেল, যেকোনো ফলাফলই মেনে নিতে হবে। সে যে পরীক্ষায় বসেছে এটাই অনেক।
এরপর যা হলো, আক্ষরিক অর্থেই সাধারণত তা সিনেমায় হয়ে থাকে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, বড়জোর ফার্স্ট ডিভিশন পাবে বোন, দুটি কি তিনটি বিষয়ে লেটার থাকলেও থাকতে পারে। বাস্তবতা হলো, শুধু বাংলা ছাড়া সব বিষয়ে লেটার মার্কসসহ সেন্টার সেকেন্ড হলো সে।
সেদিন বাসায় ফিরে আসার পর দেখি মায়ের মুখ ফোলা, চোখ লাল। জানতে চাইলাম, ‘কাঁদছ কেন? খুশি হওনি?’
আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাইয়ার মৃত্যুর প্রায় পাঁচ মাস পর কেঁদে উঠলেন জননী, ‘পলাশের অনেক শখ ছিল, যূথী স্টার মার্কস পাবে, ছেলেটা দেখে যেতে পারল না!’
আমি শুধু ভাবি, আমার মা, আমাদের মা, প্রায় সদ্য তারুণ্যে পৌঁছা এক পুত্র হারানোর শোক, নীরবে, কত গভীর সহিষ্ণুতায় অপর দুই সন্তান, স্বামী ও সংসারের কথা ভেবে চেপে রেখেছিলেন এতগুলো দিন! কী করে পেরেছিলেন? মা বলেই কি এত অসীম ধৈর্য দিয়ে তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তা? মায়েদের ওভাবে তৈরি করা হয়?
আহা…