পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি—তিন পরীক্ষাতেই মেধার প্রমাণ দিয়ে বৃত্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু কলেজে উঠে কেন প্রায় পাঁচ বছর পড়ালেখা থেকে দূরে থাকলেন তিনি? দূরত্ব ঘুচিয়ে কীভাবেই–বা আবার ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের পরীক্ষায় প্রথম হয়ে গেলেন? অনন্য গাঙ্গুলীর পুরো গল্পটা তাঁর নামের মতোই ‘অনন্য’ বটে।
অনন্য গাঙ্গুলী যখন স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় ‘ছক্কা হাঁকাচ্ছিলেন’, তখনই বিপত্তি বাধায় নানা ধরনের অসুখ। মাধ্যমিকের শুরুতেই অনিয়মিত হয়ে পড়েন তিনি। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এই তরুণ বলেন, ‘ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার গ্যাস্ট্রিক আলসারের কিছু জটিলতা দেখা দেয়। সে সময় বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলও বেশ খারাপ হয়েছিল।’ প্রচুর বই পড়তেন। তাই স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও ছিলেন পরিচিত মুখ।
অনন্যর মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন পার হয়েছে যে প্রতিষ্ঠানে, সেই কোটচাঁদপুর সরকারি মডেল পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা হলো। ছাত্রের অনিয়মিত উপস্থিতি নিয়ে সে সময় বেশ চিন্তায় পড়েছিলেন তিনি। বললেন, ‘অনন্য বেশ মেধাবী ছিল। কিন্তু স্কুলে কমই আসত। আমি সে সময় প্রায়ই ওর বাসায় খবর নিতে যেতাম। অসুস্থতাসহ নানা কারণেই স্কুলে ওর উপস্থিতি কম ছিল বলে জানতাম।’
ক্লাসে কখনো নিয়মিত, কখনো অনিয়মিত, এভাবেই চলেছে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। এসএসসি পরীক্ষার আগে নির্বাচনী পরীক্ষায়ও ফল ভালো হয়নি তাঁর। যদিও এর প্রভাব তিনি মূল পরীক্ষায় পড়তে দেননি। ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ঠিকই পেয়েছেন জিপিএ–৫, সঙ্গে যশোর বোর্ডের সাধারণ বৃত্তিও।
এসএসসিতে এত ভালো ফলের পরও হুট করেই যেন হারিয়ে যান অনন্য। সহপাঠী, শিক্ষক থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী কেউ জানতেন না তাঁর খবর। অনেক দিন পর জানা গেল, অনন্যর মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘মাধ্যমিকে থাকতেই মানসিকভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হতে শুরু করে। মা-বাবা দুজনই শিক্ষিত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমার মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে তাঁরা শুরুতে বেশ উদাসীন ছিলেন। এর মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে এসএসসি পরীক্ষাটা দিয়েছি।’
অনন্যর বাবা প্রদ্যুৎ কুমার গাঙ্গুলী কোটচাঁদপুর পৌর মহিলা ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। মা রাধারানী ভট্টাচার্য্য স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। ছেলের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সে সময়ের উদাসীনতার কথা স্বীকার করলেন অকপটেই। বললেন, ‘শুরুতে আমরা ওর সমস্যাকে গুরুত্ব দিইনি। বকাঝকা করেছি, কিন্তু বোঝার চেষ্টা করিনি। পরে যখন ও আমাদের বোঝাল, তখন আমরা চিকিৎসার উদ্যোগ নিই।’
এসএসসির পর মানসিক এই জটিলতা আরও প্রকট হতে শুরু করে। অনন্য বলেন, ‘তখন মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার, ওসিডি ও অ্যাংজাইটিতে ভুগছিলাম আমি। প্রথমে যশোর, এরপর ঢাকায় চিকিৎসা হলো। উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের তামিলনাড়ুর ভেলোরের একটি হাসপাতালেও নেওয়া হলো। এসব চিকিৎসা নিয়ে মানসিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তখনো নিজেকে আমি পুরোটা ফিরে পাইনি।’
ভারতে চিকিৎসা নেওয়ার পর দেশে নিয়মিত কাউন্সেলিং চলতে থাকে। ফলে, ২০১৬ থেকে ২০২১—প্রায় পাঁচ বছর বন্ধ থাকে অনন্যর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা।
২০২১ সালে একটু সুস্থ বোধ করতে শুরু করেন অনন্য গাঙ্গুলী। ঠিক করেন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবেন। পরীক্ষার মাত্র কয়েক মাস আগে শুরু হয় প্রস্তুতি। করোনাকালীন বাস্তবতায় সেবারের এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। এ ঘটনাই কিছুটা আশীর্বাদ হয়ে আসে অনন্যর জন্য। সে বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তাঁর এইচএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল ২০১৮ সালে। কিন্তু তা আর হলো কই! পাক্কা ৩ বছর পর, ২০২১ সালে কোটচাঁদপুরের সরকারি খন্দকার মোশাররফ হোসেন ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অনন্য পান জিপিএ–৫। তবে জিপিএ–৫-এর চেয়েও বড় অর্জন ছিল আদতে নিজেকে ফিরে পাওয়া।
অনন্য বলেন, ‘রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম অনুযায়ী সে বছরই ছিল আমার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার শেষ সুযোগ। নইলে রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যেত। এইচএসসির পর প্রথম ভর্তি পরীক্ষা ছিল বিইউপিতে (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস)। প্রস্তুতি ছাড়াই সেখানে পরীক্ষা দিলাম। চান্সও পেয়ে গেলাম। তখন উপলব্ধি হলো, না পড়ে যদি বিইউপিতে চান্স পাই, তাহলে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তো পেতে পারি। তখন থেকেই ঘ ইউনিট–কেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করি। একটি কোচিং সেন্টারের অনলাইন ব্যাচে ভর্তি হই। অনলাইন হওয়ার সুবাদে বাসায় থেকেই ক্লাস করতাম। নিয়মিত পড়তাম তখন। দিনের বেশির ভাগ সময়ই বইয়ের পেছনে লেগে থাকতাম। কোচিং সেন্টারের লেকচারগুলো থেকে নোট নিয়ে রাখতাম। বাংলা ও ইংরেজিতে আগে থেকে দক্ষতা ছিল বলে ব্যাপারটা আমার জন্য বেশ সহজ হয়ে গেল।’
এতটাই ‘সহজ’ হয়ে গিয়েছিল যে ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ফেলেন অনন্য গাঙ্গুলী। যেদিন ফল প্রকাশ হলো, সেদিনের কথা জানতে চাই তাঁর কাছে। বললেন, ‘স্বাভাবিক একটা দিনই ছিল। সকালে জানতে পারলাম দুপুরে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। বাসায় নিজের ঘরেই ছিলাম। মা-ই প্রথমে খবর পেলেন, আমি নাকি ফার্স্ট হয়েছি। মা আমাকে জানালেন। পরে ওয়েবসাইট থেকে নিজে কয়েকবার চেক করে নিশ্চিত হই যে সত্যিই ফার্স্ট হয়েছি।’
অনন্যের এই ‘অনন্য’ অর্জন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মা রাধারানী ভট্টাচার্য্য। ১৮ অক্টোবর ঝিনাইদহে নিজ বাড়িতে বসে তিনি বলছিলেন, ‘সন্তানকে বুঝতে হবে আগে। সে কী চায়, কিসে তাঁর আগ্রহ—এসব জানতে হবে। নিজের চাওয়া-পাওয়া সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না। পড়াশোনার ব্যাপারে কিছুটা স্বাধীনতা সন্তানকে দিতে হবে। পড়ার টেবিলের বাইরেও একটা জগৎ আছে, সেটা জানাতে হবে। নিয়মিত খেলাধুলায় অংশ নিতে দিতে হবে।’
একটু দেরিতে হলেও রাধারানীর মধ্যে এসব উপলব্ধি এসেছিল। তাই ‘হারিয়ে ফেলেও’ সন্তানকে ‘ফিরে পেয়েছেন’ আবার। অনন্য গাঙ্গুলী এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার লক্ষ্য তাঁর।