মন খুলে কথা বলে, সবার সঙ্গে মেশে, যোগাযোগ রাখে, এমন মানুষকে সবাই পছন্দ করে। আর যারা কথা কম বলে, ভিড় এড়িয়ে চলে, একা থাকতে পছন্দ করে, বেশির ভাগ মানুষই তাদের সমালোচনা করে। এসব বৈশিষ্ট্য কি তাহলে খারাপ? মনোবিদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানার চেষ্টা করলেন লেখক
অফিসের এক কোনায় বসত ছেলেটা। অফিসে তার কাজ ছিল লেখালেখি। তার লেখার হাত ছিল দারুণ। কাজও করত একমনে। তবে কথা বলত খুব কম। ‘এই তুমি কথা বলো না কেন?’, ‘ওকে দিয়ে হবে না, ও তো কথা কম বলে’ এমন প্রশ্ন তাঁকে দিনে অন্তত দশবার শুনতে হতো। উত্তরে সে একটু হাসত। মাঝেমধ্যে পাল্টা প্রশ্ন করত, ‘কী নিয়ে কথা বলব, বলুন তো।’ একটা পর্যায়ে প্রশ্নটা আর প্রশ্ন রইল না। অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সহকর্মী, সবাই যেন জেরা করতে শুরু করল তাকে।
ছেলেটির বন্ধু কম। হাতেগোনা তিন–চারজন। খুব বেশি আড্ডাবাজও সে নয়। বন্ধুদের আড্ডায়ও নিয়মিত নয়। থাকলেও চুপচাপ। বন্ধুরা অনেকেই বলে, ‘ভাব নিচ্ছে’। আড়ালে তাকে নিয়ে চলে নানা গুজব। কেউ বলে অহংকারী, কেউ অসামাজিক।
পরিবার ও আত্মীয়মহলেও ‘অসামাজিক’ কথাটা প্রায়ই শুনতে হয়। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়টি বলে বসেন, ওর আর পরিবর্তন হলো না। কেউ কেউ এমনও বলেন, ওর চিকিৎসা দরকার। এসব শুনতে শুনতে ছেলেটি হতাশ হয়ে পড়ে।
কর্মক্ষেত্রে ‘কম কথা বলা’র অপরাধে ছেলেটি তার কাজের যথাযথ মূল্যায়নও পাচ্ছিল না। আটকে যাচ্ছিল পদোন্নতি। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে দুম করে চাকরিটাই ছেড়ে দিল সে।
হতাশায় ডুবতে থাকা ছেলেটিকে এবার সত্যিই মনোবিদের কাছে যেতে হলো। সেখানে গিয়ে জানল, তার কোনো সমস্যাই নেই। এটি তার খুব সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তার ব্যক্তিত্ব অন্তর্মুখী। সব মানুষ যেমন দেখতে একরকম নয়, তেমনি সব মানুষের চরিত্রও এক নয়। কেউ বেশি কথা বলে, কেউ কম। কেউ বাইরে ঘুরতে পছন্দ করে, কারও পছন্দ ঘর। কেউ সবাইকে বন্ধু করে নিতে পারে। কেউ বা হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কাউকে মনের কথা বলতে পারে না। এ সবই মানুষের ভিন্ন ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।
জগতে আসলে সবই বৈচিত্র্যময়। সকালের রোদ আর দুপুরের রোদের প্রখরতা কি এক? বৃষ্টিও তো কত রকম! কখনো ঝিরঝিরে, তো কখনো ঝুম। বাতাসও কিন্তু কম বৈচিত্র্যময় নয়। কখনো মৃদু, কখনো ঝোড়ো। প্রতিদিনের রোদ, বৃষ্টি, বাতাসে যদি এত বৈচিত্র্য থাকে, তাহলে মানুষে কেন নয়! এটুকু বৈচিত্র্যই সমাজে অনেকে মেনে নিতে পারেন না।
যিনি মন খুলে কথা বলেন, সবার সঙ্গে মেশেন, যোগাযোগ রাখেন অর্থাৎ যিনি বহির্মুখী, তাঁকে স্বাভাবিকভাবেই সবাই বেশি পছন্দ করে। তবে যিনি কথা কম বলেন, ভিড় এড়িয়ে একটু একা থাকতে পছন্দ করেন, তাঁকেও অপছন্দ করার কিছু নেই। তিনি যে পিছিয়ে পড়েছেন, এমনটা ভাবারও কিছু নেই। কারণ, সবাইকে নিয়েই সমাজ। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের মানুষ আছে বলেই না সমাজে ভারসাম্য আছে।
মনোবিজ্ঞান বলছে, বহির্মুখীদের তুলনায় অন্তর্মুখীরা সাধারণত বেশি সৃজনশীল হয়। সত্যজিৎ রায়ের অনেক গল্প, সিনেমার প্রধান চরিত্রই কিন্তু অন্তর্মুখী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’–এ ভাবুক অপুও কিন্তু অন্তর্মুখী। সহজে সে নিজের সমস্যা, দুঃখের কথা অন্যকে বলতে পারে না। ডুবে থাকে নিজের জগতে। সেই ভাবনার জগতের সঙ্গীও হাতেগোনা। স্ত্রী অপর্ণা, বন্ধু পুলু। শংকরের উপন্যাস নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জন অরণ্য’র সোমনাথও কিছুটা অন্তর্মুখী। বেকারত্বের যন্ত্রণায় ডুবে যেতে থাকা সোমনাথ নিজের কথা ভাগ করে নিতে পারত বৌদির সঙ্গে। অনেক দিন পর্যন্ত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিজেও ছিলেন অন্তর্মুখী। নিজস্ব সাহিত্যের জগতে ডুবে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন তিনি।
মনের জগৎ নিয়ে যাঁদের আগ্রহ রয়েছে, যাঁরা কমবেশি মনোবিজ্ঞান পড়েছেন বা পড়েননি, তাঁদের অনেকেরই ব্যক্তিত্বের এই ধরন কমবেশি জানা। মনোবিদের কাছে এ সম্পর্কে আরেকটু জেনে নেওয়া যাক। অন্তর্মুখী হওয়াটা কোনো নেতিবাচকতা বা সমস্যা বলে মনে করেন না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোবিদ তানজীর আহমেদ। তিনি বলেন, এটি খুব সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তবে সমাজে অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের মানুষকে নেতিবাচকভাবে দেখার মনোভাবটা বদলানো দরকার।
যে ছেলের কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল, তার প্রসঙ্গেই ফেরা যাক। মনোবিদ তানজীর বলেন, একেক ধরনের ব্যক্তিত্বের মানুষ একেক কাজে পারদর্শী। কর্মস্থলেও সেটা বোঝার দায়িত্ব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের মানুষ কিছু কাজে ভালো করেন। বহির্মুখীরাও কিছু কাজে ভালো করেন। মানুষের সঙ্গে বেশি যোগাযোগের এবং প্রভাবিত করার কাজে বহির্মুখীরা বেশি পারদর্শী। অন্যদিকে সৃজনশীল কাজ অন্তর্মুখীরা ভালো করেন।
বিবাহিত জীবনেও সমস্যায় পড়তে পারেন অন্তর্মুখীরা। ‘অপুর সংসার’–এর অপু আর অপর্ণার মতো যদি দুজনই কাছাকাছি ব্যক্তিত্বের না হন, তাহলে হতে পারে জটিলতা। স্বামী ও স্ত্রী দুজন দুই ব্যক্তিত্বের হলে নানা বিষয়ে অসন্তুষ্টি, ভুল–বোঝাবুঝি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বোঝাপড়াটা জরুরি। বিয়ের আগে ব্যক্তিত্বের ধরনগুলো মিলিয়ে নিলেও জটিলতা এড়ানো যায় বলে মনে করেন মনোবিদ তানজীর।
আসলে বৈচিত্র্যে ভরা সুন্দর প্রকৃতির মতো অন্তর্মুখী বা বহির্মুখী বৈচিত্র্যময় সব মানুষকে নিয়েই সমাজটা সুন্দর।