বিভিন্ন দিবসে স্মারক ডাকটিকিট ও খামের নকশা করেন বনি আদম

বিভিন্ন দিবসে স্মারক ডাকটিকিট ও খাম প্রকাশ করে থাকে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। গত ৯ বছরে এ রকম ৪০টি ডাকটিকিট ও খামের নকশা করেছেন বনি আদম। আজ জাতীয় ডাক দিবসে এই নকশাকারের গল্প শোনাচ্ছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

ডাকটিকিট নকশা করছেন বনি আদম
ছবি: প্রথম আলো

ছোটবেলা থেকেই ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ। তবে নিজে যে কখনো ডাকটিকিটের নকশা করবেন, ভাবেননি। অভাবনীয় সেই সুযোগই সামনে হাজির হলো ২০১৫ সালে। সে বছর স্মারক ডাকটিকিটের নকশাবিদ হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার দরখাস্ত আহ্বান করে ডাক বিভাগ। আবেদন করেন বনি আদম। আবেদনের সঙ্গে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ওপর একটি স্মারক ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খামের নকশাও চাওয়া হয়েছিল। হাতে এঁকে একটি নকশা দাখিল করেন বনি আদম। সে সময় নকশাবিদ হিসেবে যে তিনজন মনোনীত হন, তাঁদেরই একজন বনি আদম। সেই থেকে ডাকটিকিটের নকশাবিদ হিসেবে কাজ করছেন তিনি। বর্তমানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যাপক। পেশাগত কাজের বাইরে শখের বশে স্মারক ডাকটিকিটের নকশা করে থাকেন। সেদিন তাঁর বাসায় বসে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ডাকটিকিট নকশার গল্প শুনলাম।

রাধারমণ স্মরণ

২০১৫ ছিল মরমি কবি রাধারমণ দত্তের মৃত্যুশতবার্ষিকী। নকশাবিদদের কাছে ডাকটিকিটের নকশা আহ্বান করে ডাক বিভাগ। বনি আদম নকশা করতে গিয়ে দেখেন, রাধারমণের জুতসই কোনো পোর্ট্রেটই নেই। অনলাইনে পাওয়া কয়েকটি ছবিই ভরসা। সেসব দেখে নিজের মতো করে রাধারমণ দত্তকে আঁকলেন বনি আদম। তিনি রঙের মিশ্রণ দিয়ে এমনভাবে ছবিটি আঁকলেন যে দেখে মনে হয় শতবর্ষ আগে আঁকা। বনি আদমের সেই নকশাই নির্বাচিত হয়। প্রথম করা নকশাটিই চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি আজও তাঁকে আনন্দিত করে। তিনি বলেন, ‘আমার করা প্রথম টিকিটটিই নির্বাচিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ছিল।’

বনি আদমের নকশা করা কয়েকটি ডাকটিকিট

ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার

রিও অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে। ব্রাজিলে আয়োজিত অ্যাথলেটদের এই মহা ক্রীড়াযজ্ঞ নিয়ে ডাকটিকিটের নকশা আহ্বান করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। বনি আদম চিন্তা করলেন, এমন ছবি নির্বাচন করতে হবে যা ব্রাজিলকে প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি রিও ডি জেনিরোর ‘ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার’ নামে যিশু খ্রিষ্টের বিরাট ভাস্কর্যটিকে নকশা হিসেবে বেছে নিলেন। ভাস্কর্যের পশ্চাদভূমিতে শহরকে রেখে তিনি নকশা তৈরি করলেন। ডাক বিভাগ এটিকে মনোনীত করে। একটি স্যুভেনির শিটের মাঝখানে ডাকটিকিটটি রয়েছে। স্যুভেনিরের ডিজাইন করেন সনজীব কান্তি দাস।

বনি আদম জানান, প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিটটি সরাসরি ব্রাজিল সরকারের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন সে সময় ব্রাজিলে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মিজারুল কায়েস।

বনি আদম

ডাকটিকিটে স্বাধীনতা

বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই। নকশা করেন লন্ডনপ্রবাসী ভারতীয় বাঙালি শিল্পী বিমান মল্লিক। তাঁর আঁকা আটটি ডাকটিকিট বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে জানান দেয়। এই টিকিট প্রকাশনার ৫০ বছর পূর্তি ছিল ২০২১ সালের ২৯ জুলাই।

বিমান মল্লিকের আটটি ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খামের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশের ডাকটিকিট প্রকাশের সুবর্ণজয়ন্তী (১৯৭১-২০২১)’ শীর্ষক ডাকটিকিটের নকশা প্রণয়ন করেন শিল্পী বনি আদম। নকশাবিদ বনি আদমের কাছে এই ডাকটিকিটের নকশা প্রণয়নের অনুভূতিই অন্য রকম, ‘কাজটি আমার জন্য গর্বের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব। আবার শিল্পী হিসেবে নিজের কাজের মাধ্যমে শিল্পী বিমান মল্লিকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পেরেছি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জুলিও কুরি শান্তি পদকপ্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তিতে স্মারক ডাকটিকিটটি নকশা করেন বনি আদম

বঙ্গবন্ধুর শান্তি পদকপ্রাপ্তি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জুলিও কুরি শান্তি পদকপ্রাপ্তির প্রকৃত ছবি বাছাই করতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন বনি আদম। অনলাইনে অনুসন্ধান করে কয়েক ধরনের ছবি পান। এমনকি বঙ্গবন্ধুর অন্য পদকপ্রাপ্তির ছবি জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তির ছবি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ মূল পদকের এক পাশে জুলিও কুরি ও অপর পাশে শান্তির প্রতীক হিসেবে একটি পায়রার ছবি রয়েছে, যে ছবি পাবলো পিকাসোর আঁকা। এই ছবি শনাক্তকরণে সহযোগিতা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে মুজিবপিডিয়ায় প্রকাশিত ছবিটি সঠিক। পদকের লেখাটি ছিল ফরাসি ভাষায়। তাই তিনি আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য এ বিষয়ে আমেরিকাপ্রবাসী গবেষক ও সংগ্রাহক মাহাবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী ফরাসি। তিনি বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করেন। তারপর নকশা করেন বনি আদম।

ডাক বিভাগের আহ্বানে স্মারক ডাকটিকিট জমা পড়লেও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নকশা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত করে থাকেন। বনি আদম বলেন, ‘আমার করা এই স্মারক ডাকটিকিটও প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত করেন।’

বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশের ৫০ বছর পূর্তির স্মারক ডাকটিকিট নকশা করেন বনি আদম

জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি

প্রথমে জাতীয় সংসদ ভবনের ছবি দিয়ে স্মারক টিকিটের নকশা করার কথা চিন্তা করেছিলেন বনি আদম। কিন্তু বর্তমান সংসদ ভবনের নির্মাণকাজই শেষ হয় ১৯৮২ সালে। আর দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসেছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। সংসদ ভবনের ছবি থেকে নকশা না করে তিনি খুঁজতে থাকলেন প্রথম সংসদ অধিবেশনের ছবি। ছবির জন্য এখন অনলাইনকেই ভরসা করে থাকেন। কিন্তু সংসদের প্রথম অধিবেশনের ছবি তিনি অনলাইন ঘেঁটেও বের করতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের আর্কাইভসে রক্ষিত সে সময়ের পত্রিকা ঘাঁটতে থাকেন। একপর্যায়ে ইত্তেফাকে প্রকাশিত ছবিটি পেয়ে যান। অধিবেশনের পরদিন পত্রিকায় ছবিটি ছাপা হয়েছিল। সেই ছবি দিয়েই তিনি ডাকটিকিটের নকশা প্রণয়ন করেন। বনি আদমের নকশা করা সেই স্মারক ডাকটিকিট এখন জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনের অংশ।

ঐতিহাসিক আরও কিছু স্মারক ডাকটিকিটের নকশাকার বনি আদম। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের ৫০ বছর পূর্তি, মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ৫০ বছর, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ৫০ বছর পূর্তির উদ্বোধনী খাম, গণ-অভ্যুত্থান দিবসের ৫০ বছর, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি পেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশের বনফুল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের যুদ্ধাপরাধ, মহান জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস ২০২৩, বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ও তথ্য সংঘ দিবস শীর্ষক ডাকটিকিটসহ বিভিন্ন জাতীয় ও ঐতিহাসিক দিবসের স্মারক ডাকটিকিটের নকশা তিনি প্রণয়ন করেছেন। বনি আদম বলেন, প্রতিটি ডাকটিকিটের সঙ্গে নিজের নামটি জড়িয়ে যায়। মনের এই তৃপ্তির জন্যই কাজটি করে যাচ্ছি।