গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন ১৩ জেলে। আবহাওয়া খারাপ হলো। ঢেউয়ের তোড়ে উল্টে গেল ট্রলার। এক দিন এক রাত ধরে সাগরে ভাসার পর অজানা এক চরে ঠাঁই হলো। একে একে হারিয়ে গেলেন দলের চারজন। ইউসুফ আলীর কাছে বেঁচে ফিরে আসার অবিশ্বাস্য সেই গল্পই শুনলেন নেছারউদ্দিন আহমেদ
ট্রলারের কত বাহারি নাম থাকে। কিন্তু ওবায়দুল গাজীর ট্রলারটা অনামা। ট্রলারের দলনেতা আমাদের পশুরবুনিয়া গ্রামের হিরণ মাঝি। ট্রলারে তার সঙ্গে অনেক দিন ধরেই কাজ করি। আমার মতো আরও অনেকেই করে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নানা গ্রামে সবার বাড়ি।
মাসখানেক আগে সমুদ্র থেকে ফিরেছি। ঠিক হলো ১৮ আগস্ট সকালে আবার আমরা ঘাট ছাড়ব। মাঝি, জেলেসহ ১৩ জনের দল। ১৫ দিন সাগরে থাকার প্রস্তুতি নিয়েছি। কত কী যে নিতে হয়—চাল, ডাল, আনাজ, তরকারিসহ প্রয়োজনীয় জ্বালানি।
কলাপাড়ার মহিপুর মৎস্যবন্দরের অনেক নামডাক। শিববাড়িয়া নদীপাড়ের বন্দরটা ট্রলার আর জেলেনৌকায় সব সময় গমগম করে। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হলো।
দিনটা ছিল ১৮ আগস্ট, বৃহস্পতিবার। শিববাড়িয়া নদী ধরে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ল ট্রলার। ৪২ বছরের জীবনে বড় একটা সময় নোনাজলেই কাটল। জেলে–সন্তান আমরা, মাছ ধরা ছাড়া আর কোনো কাজ তো পারি না। তাই হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে দরিয়ায় ভাসি আমরা। কতজনকে দরিয়ায় হারিয়ে যেতে দেখলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে এসব কথা মনে পড়ে। কেমন যেন দুঃখ দুঃখ লাগে। প্রথম দিন বাড়ির কথা বেশি মনে হয়, পরিবারের কথা মনে হয়।
ঘাট ছাড়ার সময় জেনেছি, সাগরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত জারি আছে। সাগরের আবহাওয়া অনুকূল না। এসবে মন দিলে অবশ্য আমাদের চলে না। হিরণ মাঝির ডাকে উঠে বসি। আমরা গভীর সমুদ্রে পৌঁছে গেছি। বাংলাদেশ সীমানার সর্বশেষ ‘বয়া’ দেখা যাচ্ছে। জাল ফেলার প্রস্তুতি নিই। আমাদের জালটা ৬০০ ফ্লুটের (জাল ভাসিয়ে রাখার উপকরণ)। লম্বায় প্রায় ১০ হাজার ৮০০ হাত (১৬ হাজার ২০০ ফুট)। ধীরে ধীরে জাল ফেলি।
এবার শুধু অপেক্ষা। মাছ জালে পড়ার অপেক্ষা।
১৯ আগস্ট। সকাল ৬টা। প্রচণ্ড ঢেউয়ে ট্রলারটা দুলছে। পানি থেকে জাল তুলতে থাকি আমরা। জাল তুলতে অনেক সময় চলে যায়। ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তবে জাল তুলে মনটা ভালো হয়ে যায়। অনেক মাছ উঠেছে। ইলিশ মাছে চকচক করতে থাকে নৌকার পাটাতন। অন্য মাছও কম না। মনে হলো, সব মিলিয়ে তিন লাখ টাকার মাছ হবে। সবার চোখমুখে আনন্দ।
মাছের নেশায় সাগরের দিকে খেয়াল করা হয়নি। কেমন পাগলাটে আচরণ করছে সাগর। একের পর এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। এমন ঢেউ শেষ কবে পেয়েছি, মনে করতে পারি না। ঢেউয়ের আকার বড় হতে থাকে। এর মধ্যে শুরু হয় বাতাস আর বৃষ্টি।
প্রকৃতির হাবভাব দেখে সব গুটিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল হিরণ মাঝি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম আরও কয়েকটা ‘খেও’ দিতে পারলে অনেক মাছ হবে। কিন্তু কপাল খারাপ। মাছবোঝাই ট্রলার মৎস্যবন্দরের দিকে ফিরে চলল। সঙ্গী উন্মত্ত ঢেউ।
সকাল সাড়ে ৯টার মতো বাজে। ট্রলারে শক্ত হয়ে বসে আছি। ঢেউয়ের তোড়ে বড় নৌযানটা এমনিতেই লাফাচ্ছে। এমন সময় পাহাড়সমান এক ঢেউয়ের ঝাপটায় উল্টে গেল ট্রলার। পানির নিচে তলিয়ে যাই। মাথা তুলে দেখি একেকজন একেক জায়গায় ভাসছে। সবার বাঁচার আকুতি। কিন্তু কে কাকে সাহায্য করবে।
ট্রলার থেকে জালটাও পড়ে গিয়েছিল। জালের ফ্লুট ভাসতে থাকে। নাগালে পেয়ে একটা ফ্লুট জাপটে ধরি। আমার মতো অন্যরাও ফ্লুট ধরে ভাসতে থাকে। তখন খেয়াল করি ইঞ্জিন রুমের দুজন আমাদের সঙ্গে নেই। আব্বাস খাঁ ও জুয়েল খাঁ ট্রলার থেকে বের হতে পারেনি।
হিরণ মাঝি দলনেতা। সবচেয়ে সাহসী মানুষ। সবাইকে সাহস দিতে থাকে।
জালের ফ্লুট ধরে ভাসছি তো ভাসছি। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। উত্তাল ঢেউ আসছে। আমরা ঢেউয়ের সঙ্গী। হিরণ মাঝির পরামর্শ, একজন একেক দিকে যেন চলে না যাই, একে একে সবার কোমরে দড়ি বাঁধি। মরলে একসঙ্গে মরব, বাঁচলে একসঙ্গে বাঁচব।
নিজেদের সাগর জলে সঁপে দিই। সারা দিন এভাবেই কেটে যায়। ক্ষুধায় শরীরটা আর চলে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আবছা অন্ধকারে সমুদ্রকে আরও ভয়ংকর মনে হয়। একজন আরেকজনকে দেখতে পারছিল না। রাত যত গভীর হতে থাকে, ততই ভয় চেপে ধরে। কেউ ভয় পেলে নাম ধরে ডেকে ওঠে। অন্যরাও সাড়া দেয়। কিছুটা ভয় কেটে যায়।
ভেসে ভেসে আমরা যে কোন দিকে যাচ্ছি, বুঝতে পারি না। এমন সময় রাকিবুল ইসলামের আর্তনাদ শুনতে পাই। রাত তখন ৮-৯টা হবে হয়তো। বুঝতে পারি, ক্লান্ত শরীর নিয়ে সে নোনাপানিতে ডুবছে। তবু তার কণ্ঠে বাঁচার আকুতি। শেষমেশ রাকিবুল ডাক দিয়ে শুধু বলল, ‘মোরে তোমরা মাফ কইর্যা দিয়ো।’
জনমানবহীন চরে লাশের মতো শুয়ে পড়ি। কখন রাত পার হয়ে সকাল হয়েছে জানি না। চেতনা ফিরলে ওঠার চেষ্টা করি। পারি না। শরীরে একটু শক্তিও আর নেই। কারও মুখে কোনো কথা নেই। অন্যরা বেঁচে আছে না মরে গেছে, বুঝতেও পারি না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকি।
২০ আগস্ট। শনিবার। সকালের আলো ফুটল। সাগরে এক দিন পেরিয়ে গেছে। ভাসতে ভাসতে কোথায় আছি বুঝতে পারি না। নোনাপানি খেয়ে অনেকের বমি হয়েছে। পেটে দানাপানি পড়েনি, শরীর আর চলে না। ভেসে আছি তো আছিই। তবে দিনের আলো বাঁচার আশা জাগায়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাসছিলাম। আমরা বলি মরা সাঁতার। এমন সময় ‘চর, চর’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে হিরণ মাঝি। তাকিয়ে দেখি দূরে চর আর গাছপালা। দেখে মনে হয় সুন্দরবন।
একে একে ১০ জন উঠে আসি চরে। হিরণ মাঝি ইতিউতি করে বুঝতে পারে, চরটা সুন্দরবনের পুব দিকে। নাম ‘দ্বীপ চর’, কেউ কেউ বলে ‘কালীরচর’।
সমুদ্র থেকে চরে উঠে সটান বালুতে শুয়ে পড়ি। ক্ষুধায় নড়তে পারি না। পানির তেষ্টায় বুকটা কাঠ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। পাশে দেখি বৃষ্টির কাদাপানি জমে আছে। কী আর করা, কাদাপানিতেই তৃষ্ণা মেটাই।
সামান্য শক্তি পাই। হাঁটতে থাকি। হাঁটি, থামি, আবার হাঁটি। কিন্তু কোনো দিক খুঁজে পাই না। চরটা কাঁকড়ায় ভরা। ক্ষুধার জ্বালায় একসময় কাঁকড়া ধরে কাঁচাই খেয়ে ফেলি। সুন্দরবন এলাকা। চরে কেওড়াগাছ আছে। কেওড়া ফল, পাতাও খাই। এভাবে দুই দিন দুই রাত কেটে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে দুই চরের মাঝখানে একটি খাল দেখতে পাই। পেছনে সমুদ্র। সামনে এগোতে হলে খাল পার হতে হবে। গাছ সংগ্রহ করি। ভেলার মতো বানাই। সেই ভেলায় ভর করে সাঁতরে পূর্ব পাড়ের চরে উঠি।
১০ জন একসঙ্গে থাকি। নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করি। অচেনা চরটায় (পরে জেনেছি এটা ছোদনখালীর চর) দেড় দিনের মতো হাঁটি। এর মধ্যে দুলাল হাওলাদার খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি আর পাতলা পায়খানা হয়ে হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাকে নিয়ে কী করা যায়?
সিদ্ধান্ত হয় পালা করে দুলালকে বয়ে নিয়ে যাব। অসুস্থ শরীরে সেভাবেই এগোতে থাকি। দুলালের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। তাকে চরের একটি জায়গায় রেখে সাধ্যমতো সেবাযত্ন করি। কিন্তু কী করব, সেখানে না আছে খাবার, না আছে পানি।
এদিকে কারও পেটে কিছুই পড়েনি। খাবারের খোঁজে বনের দিকে এগোই আমরা। দুলালকে রেখে যাই। ফিরে এসে আর দুলালকে পাইনি। তার পরিণতি ভেবে আরও ভেঙে পড়ি।
পা আর চলছিল না। জনমানবহীন চরে লাশের মতো শুয়ে পড়ি। কখন রাত পার হয়ে সকাল হয়েছে জানি না। চেতনা ফিরলে ওঠার চেষ্টা করি। পারি না। শরীরে একটু শক্তিও আর নেই। কারও মুখে কোনো কথা নেই। অন্যরা বেঁচে আছে না মরে গেছে, বুঝতেও পারি না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকি।
এমন সময় কানে আসে নৌকার শব্দ। খালের পাশে শুয়ে আমরা ৯ জন। পাশে এসে কারা যেন কী জিজ্ঞেস করে। উত্তর না পেয়ে আমাদের কাছে আসে। চোখ খুলে দেখি মানুষের মুখ। তারা নানা প্রশ্ন করে, আমরা কেউ কোনো উত্তর দিতে পারি না। সেই শক্তিও যে আমাদের নেই।
আমাদের একে একে টেনে তুলল তারা। পাঁজাকোলা করে বোটে তুলল। পানি খাওয়াল। প্রাথমিক চিকিৎসা দিল। তারপর নিয়ে এল আংটিহারা কোস্টগার্ড টহল ফাঁড়িতে। বেঁচেবর্তে ফিরছি ভেবে চোখ গড়িয়ে পানি এল।
২৩ আগস্ট আমাদের সুন্দরবনের ছোদনখালী খালের চর থেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড ও বন বিভাগ। সেখান থেকে মোংলা কোস্টগার্ড কার্যালয়ে নিয়ে আসে। মোংলা থেকে আমাদের পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়। আমরা নয়জন এখন কলাপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছি।