নারীরা এখানে সব কথা বলতে পারবেন

২০২২ সালের জুনে ছয়জন মিলে শুরু করেন শান্তিবাড়ির কার্যক্রম। নারীর পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়ানোই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য

‘তিন-চার মাস আগে আমার ঘর থেকেও ছিল না। ঢাকা শহরের পার্কে, ফুটপাতে, এমনকি বাসে বাসেও ঘুরেছি। ঘরে ফিরতে চাইতাম না। শান্তিবাড়ি আমাকে ঘরে ফিরিয়েছে, ঘর যে আসলেই শান্তির জায়গা, তা আমাদের পুরো পরিবারকে বুঝিয়েছে,’ বলছিলেন জাকিয়া দ্যূতি। জাকিয়ার বয়স ত্রিশ। মা–বাবা হারানো এ তরুণীকে বড় করেছেন তাঁর বড় বোন। বোহিমিয়ান জীবন থেকে বের করে আনতে বড় বোনই তাঁকে শান্তিবাড়িতে নিয়ে আসেন। তাঁদের কাউন্সেলিংয়ে চার মাসেই বদলে গেছে জাকিয়ার জীবন। জাকিয়ার মতো এমন অনেক নারীই সেবা নিতে শান্তিবাড়িতে আসেন।

শান্তিবাড়ির সুলুক সন্ধান করতে একদিন বেরিয়ে পড়ি। রাজধানীর লালামাটিয়ায় প্রতিষ্ঠানটির প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই বই আর মনখুশি অন্দরসজ্জা দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। ভেতরে কেউ কাউন্সেলিং কক্ষে সেশন করছেন, কেউবা মাদুরে পেতে বই পড়ছেন, আয়েশ করে মজাদার সালাদ বা মসলা–চা খাচ্ছেন কেউ। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ দোলনায় দোল খাচ্ছেন একজন।

শারমিন শামস্, সুমী শাহাবুদ্দিন, কিশোয়ার জাবীন, নাহিদ শামস্, অপরাজিতা গোস্বামী ও অনির্বাণ ভৌমিক—ছয়জন মিলে ২০২২ সালের জুনে শুরু করেন শান্তিবাড়ির কার্যক্রম। অন্যতম উদ্যোক্তা শারমিন শামস্ জানান, ‘আমরা দেখেছি, পরিবার-পারিপার্শ্বিক নানা বিশৃঙ্খলায় নিরিবিলিতে একটুখানি বসে থাকার সুযোগও মেয়েরা কোথাও পায় না। মনের কথা বলে নিজেকে হালকা করতে চায় তারা। কিন্তু কাকে বলবে? কোনো রকম জাজমেন্টাল মনোভাব ছাড়া কে শুনবে তাদের কথা? শান্তিবাড়ি শুনবে। মেয়েদের নিজেদের মধ্যে মন খুলে কথা বলার জন্য আয়োজন রেখেছি। শান্তিবাড়ি আসলে একটা পরিবার। পরিবারের মতো ভালোবেসে, যত্ন করে তাদের মনের কথা শুনছি আমরা। কাউন্সেলিং করাচ্ছি। আইনি সহায়তা দিচ্ছি।’ আরেক প্রতিষ্ঠাতা সুমী শাহাবউদ্দিন জানান, ‘নারীর বিকাশ, প্রকাশ, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং—সর্বোপরি নারীর মনের পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়ানোই আমাদের লক্ষ্য।’

শান্তিবাড়ির প্রতিষ্ঠাতার চারজন সুমী শাহাবুদ্দিন, নাহিদ শামস্, শারমিন শামস্ ও কিশোয়ার জাবীন

শান্তিবাড়ির আইনজীবী নাহিদ শামস্ জানান, ‘আইনি সহায়তা নিতে মেয়েরা আসলে কোথায় যাবে, কাকে বলবে নিজের নিপীড়নের কথা, বুঝে উঠতে পারে না। এখানকার লিগ্যাল উইং পারিবারিক সালিস, কাস্টডি, দেনমোহর, তালাকে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে ফৌজদারি মামলা, সম্পত্তির ঝামেলা, সাইবার ক্রাইমের বিষয়েও আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে শান্তিবাড়ি।’ সাশ্রয়ী মূল্যে এসব সেবা দিয়ে থাকে তারা।

শান্তিবাড়ি থেকে আইনি সহায়তা নিয়েছেন এক চিকিৎসক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নারী জানান, পারিবারিক নিপীড়নের শিকার হয়ে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য স্বস্তিকর একটা জায়গার খোঁজেই তাঁর শান্তিবাড়িতে আসা। এত সুন্দরভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে দিয়েছে তারা যে বাড়তি কোনো মানসিক চাপই তাঁকে নিতে হয়নি।

শান্তিবাড়ির মনোরোগবিশেষজ্ঞ রাজিয়া সুলতানা জানান, ‘মানসিক চাপ মোকাবিলায়, মনের সুস্থতা বজায় রাখতে কাজ করছি আমরা। নিয়মিত কাউন্সেলিং ছাড়াও প্রতি মাসে একটা কর্মশালারও আয়োজন করি। আমরা বোঝাতে চেষ্টা করি, শরীরের সুস্থতায় যত্ন যেমন দরকার, তেমনি মনেরও যত্ন দরকার।’

আছে যোগাসন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও। সাশ্রয়ী মূল্যে বিশিষ্ট যোগাসনকর্মীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন নারীরা। সেই সঙ্গে নারী শিল্পীদের আঁকা ছবি, পরিচালকদের সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থাও চালু হচ্ছে।

এখানে মনের কথা খুলে বলা যায়

সামনে নতুন আরও অনেক কিছুই চালু করতে যাচ্ছে শান্তিবাড়ি। বছরের শুরু থেকেই থাকছে উদ্যোক্তা কর্নার। নারী উদ্যোক্তারা চাইলেই যেখানে তাঁদের পণ্য প্রদর্শন করতে পারবেন। তেমন একজন উদ্যোক্তার সঙ্গে দেখাও হয়ে গেল। তিনি পাটের ব্যাগ তৈরির প্রতিষ্ঠান কালিন্দির প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দা মুনিয়া জামান। মুনিয়া জানান, ‘শান্তিবাড়ির অন্দর আর কালিন্দির ব্যাগগুলোর মধ্যে কোথায় যেন সাদৃশ্য পাই। দুটোতেই মন উৎফুল্ল করা রঙের ছটা। তাই তো শান্তিবাড়িতে আমার পণ্যগুলো প্রদর্শন করছি।’

নিপীড়ন, বিষণ্নতার বলয় ভেঙে নারীরা আনন্দ করতে পারছেন, নিজেকে ভালোবাসতে পারছেন—এটাই শান্তিবাড়ির বড় প্রাপ্তি মনে করেন প্রতিষ্ঠাতারা।