হঠাৎ বন্যায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একতলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। হাসপাতালের ওষুধপত্রও নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের কার্যক্রম। তাই আমরা ভ্রমণকন্যার পক্ষ থেকে এই উপজেলার প্রত্যন্ত কোনো এলাকায় গিয়ে মেডিকেল ক্যাম্প করে বন্যাদুর্গত মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে উদ্যোগী হই।
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের পর রাতারাতি স্যালাইন, প্যারাসিটামল, জিংকসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও সংগ্রহ করে ২৪ আগস্ট ভোরে রওনা দিই। পিকআপে করে কোনোমতে চৌদ্দগ্রামে পৌঁছানো গেল, তারপরেই বিপত্তি বাধল। উপজেলা সদর থেকে আলকরা ইউনিয়নের কাজী আহমেদ আলী উচ্চবিদ্যালয়ে যাব আমরা। একটা নৌকা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু তখন সেটা আমাদের গন্তব্যের উল্টো দিকে অবস্থান করছিল। সেটাকে পিকআপে করে এনে আমরা স্কুলের উদ্দেশে রওনা দিই ।
স্কুলমাঠে পৌঁছে দেখি গলাপানি। শহীদ মিনারটাও অর্ধেক ডুবে গেছে। স্কুলের নিচতলায় কোমরপানি। সিঁড়ির কাছে নৌকা ভেড়ানো হলো। দোতলায় কয়েক ঘণ্টা ধরে ১৫০ জনের মতো মানুষকে চিকিৎসা দিই। এর মধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। কাজী আহমেদ আলী উচ্চবিদ্যালয় ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় খবর এল, পাশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বেশ কয়েকজন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নৌকা নিয়ে কয়েকজন এসেছেন আমরা যেন তাঁদের সঙ্গে যাই।
দ্বিধায় পড়ে গেলাম। নৌকায় করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আবার আমাদের ফিরতে হবে। আসার সময় ডাকাতিয়া নদীতে স্রোতের মধ্যে পড়ে প্রায় ডুবতে বসেছিলাম। এখন এই রাতের অন্ধকারে যেতে যে আরও বেগ পেতে হবে, সে তো বলা বাহুল্য। আবার দুর্গম এলাকায় এত কষ্ট করে এসে তাঁদের না দেখে ফিরে যাব? মনকে শক্ত করে সিদ্ধান্ত নিলাম, অসুস্থ মানুষদের দেখে তবেই ফিরব।
বাকগ্রামের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আমরা ১০ জন ওষুধপত্র নিয়ে পাশের ইউনিয়নের আকদিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। মাদ্রাসায় যখন পৌঁছাই, তখন রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে। তিনতলা মাদ্রাসার নিচতলা ডুবে গেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আশ্রয় নিয়েছে বন্যার্ত মানুষ। নারীরা আছেন দ্বিতীয় তলায়। আর তৃতীয় তলায় পুরুষেরা। আমরা গিয়ে দোতলার দুপাশে নারী ও পুরুষদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলাম। পুরুষদের দেখছিল চিকিৎসক ফয়সাল। আর আমি নারী ও শিশু। ওষুধ বিতরণসহ আমাদের সহযোগিতায় থাকেন অন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা।
অনেকেই এসে ত্বকের সমস্যা, সর্দি–কাশি, পেটের পীড়ার কথা বলল। তাদের চিকিৎসা দিচ্ছি, এমন সময় এসে কাকুতি–মিনতি শুরু করলেন এক মা। তাঁর শিশুসন্তানকে সঙ্গে আনতে পারছেন না, খুব অসুস্থ। আমি উঠে তাঁর রুমে চলে গেলাম। ঘরটা অন্ধকারে ডুবে আছে। মুঠোফোনের আলোয় দেখি গাদাগাদি অনেক মানুষ। তারই মধ্যে এক কোনায় ছেলেটা নিথর পড়ে আছে।
চার বছর বয়সী শিশুটির গায়ে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। ব্যাগ থেকে থার্মোমিটার বের করে জ্বর মাপলাম। ১০৩ ডিগ্রি। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে এভাবেই পড়ে আছে। অসুস্থ সন্তান নিয়ে কোথায় যাবেন, কী করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না অসহায় মা। উদ্বিগ্ন হয়ে আমার পাশে বসে পড়েন। তাঁকে দেখে মনে হলো মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ।
এমন জ্বরের সময় সাপোজিটরি দেওয়ার নিয়ম। নেবুলাইজ করতে পারলে শ্বাসকষ্টও কমত। কিন্তু আমরা সাপোজিটরি বা নেবুলাইজার কিছুই সঙ্গে আনতে পারিনি। শুধু প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিলাম। কোনটা কখন খাবে, বুঝিয়ে দিলাম। মাকে আমার মুঠোফোন নম্বরটা দিয়ে বললাম, দুই দিনের মধ্যে যদি জ্বর না কমে তাহলে যেন আমাকে জানান। ২৯ আগস্ট পর্যন্ত তিনি আমাকে কল দেননি।
জানি না শিশুটা কেমন আছে।
লেখক: চিকিৎসক