মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশের ছাঁচও তৈরি হচ্ছে যবিপ্রবির ল্যাবে

ল্যাব কোর্সের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের সিএনসি মেশিন সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন আইপিই বিভাগের চেয়ারম্যান মুজাহিদুল হক
ছবি: প্রথম আলো

শিক্ষার্থীদের শিল্পোদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল (আইপিই) বিভাগ। এই বিভাগের গবেষণাগারে আছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা কম্পিউটার নিউমেরিক্যাল কন্ট্রোল (সিএনসি) যন্ত্র। এর মাধ্যমে নানা ধরনের শিল্পপণ্য উৎপাদনের ডাইস বা মোল্ড (ছাঁচ) তৈরির কাজ শিখছেন শিক্ষার্থীরা।

একসময় ভারতসহ নানা দেশ থেকে এসব ডাইস নিয়ে আসতেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। এখন একদিকে যেমন শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কাজ শিখছেন, অন্যদিকে শিল্পোদ্যোক্তারাও কম খরচে পাচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত সেবা।

নতুন স্বপ্ন

আইপিই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদ বিন হাসানসহ পাঁচ শিক্ষার্থীর একটি দল সিএনসি যন্ত্রের সাহায্যে লোহা কেটে সিলিং ফ্যান, গ্যাসের চুলা ও মোটরসাইকেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ছাঁচ তৈরি করে। মোটরসাইকেলের পাদানির ছাঁচও তৈরি করেছে তারা, সুইজারল্যান্ডের সুইচ কন্ট্রাক্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান আয়োজিত প্রদর্শনীতে এটি প্রদর্শিতও হয়েছে।

এই দলের সদস্য সাদ বলেন, ‘আগে চিন্তা করতাম, বড় কোনো কোম্পানিতে চাকরি করব। কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির জন্য ছাঁচ তৈরি করতে গিয়ে চিন্তা-ভাবনা বদলে গেছে। এখন স্বপ্ন দেখি, আমি নিজেই একটা অটোমোবাইল শিল্পকারখানা গড়ে তুলব। যেখানে অন্তত ১০ জনকে চাকরি দিতে পারব।’

বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী জহুরুল ইসলাম চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময় সিমেন্টের পরিবর্তে প্লাস্টিক ও বালুর মিশ্রণে টাইলস তৈরি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। প্রথমে সিএনসি যন্ত্র দিয়ে ছাঁচ তৈরি করেন। পরে ওই ছাঁচে টাইলস উৎপাদনে সফল হন। এখন এই টাইলস তৈরির কারখানা দেওয়ার কথা ভাবছেন তিনি।

১৩ সেপ্টেম্বর ল্যাবে কাজ করতে করতেই জহুরুল বলছিলেন, ‘গবেষণায় দেখেছি, ফেলনা প্লাস্টিক ও বালু দিয়ে টাইলস তৈরি করা সম্ভব। এই টাইলস তৈরির কারখানা স্থাপন করতে পারলে পরিবেশের জন্যও ভালো হবে। কারণ, নর্দমায় পড়ে থাকা প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনসহ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই ক্ষতিকর প্লাস্টিক গলিয়ে তার সঙ্গে বালু মিশিয়ে ছাঁচে (ডাইস) ঢেলে টাইলস তৈরি করা যাবে। উৎপাদন খরচও অনেক কম। জাপান থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দল এই গবেষণা দেখে প্রশংসা করে গেছেন।’

আছে হাতে–কলমে কাজ শেখার সুযোগ

সেবা নিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইপিই বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিএনসি যন্ত্রটি আমদানি করা হয়। এরপর ২০২২ সালে দেশের ১৫টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ৪৪টি ও ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ৩৩টি শিল্পপণ্যের ডাইস তৈরি করেছে তারা।

মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ও প্লাস্টিকের নানা ধরনের সরঞ্জামের ডাইস তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া পোড়ামাটির টাইলস, ইটের ব্লক, পিভিসি পাইপ জয়েন্ট, সিলিং ফ্যানের যন্ত্রাংশ, ইজিবাইকের লোগোসহ বিভিন্ন কোম্পানির নানা ধরনের পণ্যের ডাইস তৈরি করা হয়েছে আইপিই বিভাগের ল্যাবে।

মোটরসাইকেলের পাদানির ছাঁচ তৈরির ফরমাশ করেছে যশোর বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন) মদিনা মেটাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ফারুক হোসেন বলেন, ‘সিএনসি যন্ত্রের কাজ আমরা সাধারণত ভারত থেকে করিয়ে আনি। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে ডাইস তৈরি করা হচ্ছে জেনে মোটরসাইকেলের পাদানির ডাইস করতে দিয়েছি। এখনো হাতে পাইনি। হাতে পাওয়ার পর কাজ চালানো গেলে আমাদের আর এই কাজের জন্য ভারতে যেতে হবে না। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক। দেশের টাকা দেশেই থাকবে। শিল্পের উৎপাদনেও এই বিভাগ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।’

ফরিদপুরের সিটি সিরামিকস নামে একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে পোড়ামাটির টাইলস উৎপাদনের ছাঁচ তৈরি করিয়ে নিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বিপ্লব বসু বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুবই চমৎকার ডাইস তৈরি করে দিয়েছেন। ওই ডাইস দিয়ে ইতিমধ্যে ঝুল বারান্দার ছাদের টাইলস উৎপাদন শুরু করেছি। এই ডাইস তৈরি করতে আমার ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।’

সিএনসি যন্ত্রে তৈরি ছাঁচ

সিএনসি যন্ত্রে ছাঁচ তৈরির প্রক্রিয়া

প্রথমে ছাঁচে উৎপাদিত পণ্যের ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) নকশা কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরি করে নেওয়া হয়। এরপর নকশাটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে কোডে রূপান্তর করে সিএনসি যন্ত্রের মেমরিতে পেনড্রাইভ বা কেব্‌লের সাহায্যে যুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে ডাইস তৈরির উপযোগী লোহা যন্ত্রের ভেতরে দিয়ে কমান্ড দিলেই যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নকশা অনুযায়ী লোহা কাটতে শুরু করে। স্বাভাবিক নকশার একটি ডাইস তৈরি করতে যন্ত্রটি সময় নেয় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা।

বিভাগের চেয়ারম্যান এ এস এম মুজাহিদুল হক বলেন, ‘দেশের দুই-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইপিই বিভাগের ল্যাবে সিএনসি যন্ত্র আছে। যার মধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটি। এই বিভাগে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা সৌভাগ্যবান; কারণ, এর আগের ১০টি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এই যন্ত্রে কাজ শেখার সুযোগ পাননি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা যন্ত্রটির দাম দুই কোটি টাকার বেশি।’

শিল্পপণ্য উৎপাদনের যন্ত্র আধুনিকায়নের পরিকল্পনার কথাও জানালেন মুজাহিদুল হক, ‘বিচালিকাটা যন্ত্রের মতো দেশের সবচেয়ে প্রচলিত আটটি যন্ত্র আধুনিকায়নে গবেষণা করার পরিকল্পনা আছে। বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রাথমিক আলোচনাও হয়েছে। আটটি যন্ত্র আমরা বাছাইও করে নিয়েছি। এটা করতে পারলে দেশের শিল্পোৎপাদন আরও আয়বর্ধক ও গতিশীল হবে।’