বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ক্রিকেট কোচ ও বিশ্লেষক নাজমূল আবেদীন
নিগার সুলতানাকে প্রথম দেখি ২০১৭ সালে, বিসিবির নারী বিভাগের দায়িত্বে আসার পর। তখনো তার খেলা সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রথম খেলা দেখার সুযোগ হলো। তখন থেকেই তার ব্যাটিং ও উইকেটকিপিংয়ের দক্ষতা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আফসোসও হতো, আরেকটু যদি ‘মাসকুলার’ হতো, শক্তি থাকত!
২০১৮ সালে বাংলাদেশ যে এশিয়া কাপ জিতেছিল, তার ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি রান করেছিল নিগার। শেষ দিকে ঝুলন গোস্বামীর মতো বোলারকে এক ওভারে তিনটি চার মেরেছিল। বাংলাদেশকে ম্যাচে এগিয়ে রেখেছিল ওই চারগুলো। মনে আছে, ২৪ বলে ২৭ রান করেছিল।
নিগার যখনই খেলে, মুগ্ধ হয়ে না দেখে উপায় থাকে না। ওর খেলার মধ্যে, বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে একটা শৈল্পিক ব্যাপার আছে। নিগারের উইকেটকিপিং দক্ষতাও অসাধারণ। দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত। এখন হয়তো অনেক মেয়েই অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধা পায়, কিন্তু তার উঠে আসার সময়ে তো এমন ছিল না। তখনো কীভাবে এত ভালো উইকেটকিপিং—শিখল, সেটা একটা বিস্ময়। ছোটবেলায় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলত, সেটাই হয়তো কারণ।
পারফরম্যান্সকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে দক্ষতা। সেই পারফরম্যান্সকে আরও অনেক ওপরে নিয়ে যায় কিন্তু সেই খেলোয়াড়ের সার্বিক ব্যক্তিত্ব। এ জায়গায় নিগার অনেক শক্তিশালী। খেলার ধরন, ব্যক্তিত্ব, যোগাযোগের দক্ষতা—সবকিছু মিলিয়েই কিন্তু ও একজন নিগার হয়ে উঠেছে। শুরু থেকেই ও জাতীয় দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পাকিস্তান, ভারতের মতো দলগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ জয়ে ওর ভূমিকা অনেক। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, মেয়েদের ক্রিকেট এগিয়ে যাওয়ার পেছনে নিগারের একটা বড় ভূমিকা আছে। সেখানে তার ব্যক্তিত্বও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদের গাইড করা, মেনটরিং করা, দলকে গুছিয়ে নেওয়া, নতুনদের সহায়তা করার ব্যাপারগুলো তার মধ্যে আছে। দারুণ একজন নেতা, জুনিয়রদের জন্য গাইড।
স্টাম্প মাইক্রোফোনে ওর কথা শুনেছি, খেয়াল করেছি—কেউ হয়তো ভালো করেনি, তারপরও রেগে যায় না। অনেক সময় দল হারলে অধিনায়ক মেজাজ হারিয়ে ফেলে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে। অভিভাবকসুলভ একটা মানসিকতা ওর মধ্যে আছে। যেকোনো দল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটা খুবই দরকার।
খেলার বাইরেও দারুণ এক মেয়ে। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি বলা এবং উপস্থাপনায়ও বেশ দক্ষ। যেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে, প্রশংসনীয়। সে তো ভালো গানও করে। আসলে ওর অনেক গুণ। সংবাদমাধ্যমে তাকে খুব একটা দেখি না, কারণ প্রচারের জন্য নিজে থেকে এগিয়ে যাওয়ার মানুষ সে না। এটাও আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। এ বয়সে, বিশেষ করে এ যুগে, নিজের প্রচারের আকর্ষণটা, নিজেকে সামনে রাখার ব্যাপারটি সামলে রাখা ওর নেতৃত্ব গুণেরই পরিচায়ক। এসব কারণেই তাকে নিয়ে অনেক আশা। সে নিশ্চয় অন্যদের মধ্যেও এটা ছড়িয়ে দিতে চাইবে।
আশপাশের মানুষ যদি একটু সহায়তা করে, তাহলে সে মেয়েদের ক্রিকেটটা অনেক দূর নিয়ে যেতে পারবে। শুধু নিজের খেলা নিয়ে নয়, দল নিয়ে, দলের সবাইকে নিয়েই ভাবে। বড় কলেবরে চিন্তা করার গুণটা ওর মধ্যে আছে। নিজে থেকেই বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখতে চায় নিগার। এখন নতুন প্রজন্মের যারা খেলে, অনেকের কাছেই সে রোল মডেল হয়ে উঠেছে। হয়তো উঠতি খেলোয়াড়েরা অধিনায়কত্বের ব্যাপারটি সেভাবে বুঝে উঠবে না, কিন্তু তার খেলাটা তো সবাই দেখে।
ক্রিকেট নিয়ে আমাদের মধ্যে যখনই আলাপ হয়েছে, নিজ শহর ময়মনসিংহে ক্রিকেট নিয়ে কী করতে পারে, সেটাও আলোচনায় এসেছে। তখনো সে অধিনায়ক হয়নি, তখন থেকেই নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বড় পরিসরে ভাবতে দেখেছি। সে সামগ্রিক ব্যাপারটা দেখতে চায়। সব মেয়েকে নিয়েই ভাবে, এগিয়ে যেতে চায়। উদাহরণ তৈরি করতে চায়। মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটা যাতে আরও ইতিবাচক হয়, এমন একটা পরিবেশ তৈরির স্বপ্ন দেখে।
তার চিন্তাভাবনা শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ নয়; যেকোনো ব্যাপারেই বাংলাদেশের মেয়েদের একটা বার্তা দেবে নিগার—আমরা যদি প্রচলিত ঘরানার চিন্তার বাইরে যাই, সুযোগ আছে। শুধু ক্রিকেট-ফুটবল নয়, যেকোনো পর্যায়েই এমন বার্তা দেবে—যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক, আমরাও পারি। আমার আশা তাই আরও বেড়ে যায়।
আশা করি, ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যাবে নিগার। শুধু মেয়েদের ক্রিকেট নয়, অন্য খেলায় বা অন্য ক্ষেত্রেও তাদের সাফল্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।