গুলিতে নিহত মাহাদী হাসানের বাবা মো. জাহাঙ্গীর হোসাইনের চোখের পানি থামছেই না
গুলিতে নিহত মাহাদী হাসানের বাবা মো. জাহাঙ্গীর হোসাইনের চোখের পানি থামছেই না

এত শূন্যতা কোথায় রাখবেন বাবারা

লাল শার্ট পরা কাকতাড়ুয়া খেতের মাঝে সটান দাঁড়িয়ে আছে। খেলতে খেলতে তা চোখে পড়ে দুই ভাই সবুজ ও মুকুলের। দুজনের পরনে পিঠছেঁড়া গেঞ্জি। তাই ঈদে লাল জামা পরার শখ হয় তাদের। বাবার কাছে বায়না ধরে তারা। অভাবের সংসারে সম্বল ছিল একটি বকনা গরু। বাবা সেই গরু বেচতে হাটে নিয়ে যান। কিনে আনবেন লাল টুকটুকে জামা। কিন্তু বাবা আর ফেরেন না। অপেক্ষায় দিন গোনে বালক দুই ভাই। অভাব আরও বেড়ে গেলে তারা গ্রাম থেকে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় চলে যায় জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে। সেখানে জাকাতপ্রার্থীদের ভিড়ে পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা যায় সবুজ। মুকুলকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন মা। অনেক দিন পর ছেলের জন্য লাল শার্ট নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন বাবাও। কিন্তু সবুজ আর নেই—এ কথা শুনে বাবার ভেতরটা কেঁপে ওঠে; মূক ও বধির হয়ে যান তিনি। মুখে কথা নেই, চোখে নেই অশ্রু। জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকেন শুধু।

আনিসুল হকের রচনা ও সাইদুল আনাম টুটুলের পরিচালনায় নাল পিরান নাটকের এই শেষ দৃশ্যে বিষণ্নতা জাপটে ধরে থাকে। অসহ্য ব্যথায় চরাচর ভেসে যায়। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা নাটকের এই বাবার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন। এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে না গেলে সেটা হয়তো বোঝা সম্ভব নয়। কারণ, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু তো বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সন্তানহারা মায়ের কষ্টের কোনো তুলনা হয় না, সে কষ্টের বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। একজন বাবা হিসেবে বরং বাবার কথাই বলি।

সন্তান বড় হতে থাকলে বাবার বুকের ভেতর যেন আনন্দে থলোথলো উড়তে থাকতে তুলো। মায়ের মতো বাবাও সন্তানের অসুখের পাশে জেগে থাকেন। প্রার্থনা করেন, সেরে যাক তার রোগের তরাস। পড়াশোনার জন্য যেদিন বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যায় সন্তান, সেদিন স্বরহীন হয়ে যান বাবা। ছোটদের মতো কেঁদে ফেলেন অকারণ। আর সেই সন্তান যদি বাড়ি ফেরে লাশ হয়ে, বাবার কী অবস্থা হতে পারে! দমচাপা কষ্টের কথা কি কাউকে বোঝাতে পারেন বাবা? অন্য কেউ কি বোঝে বাবার সেই ব্যথা?

ছেলের পাওয়া ক্রেস্টে চুমু খান মা সেলিনা বেগম। পাশে বিমর্ষ বাবা ওবায়দুল ইসলাম

তেমনই নিজের ব্যথার কথা কাউকে বোঝাতে পারছেন না ওবায়দুল হক খান নামের এক বাবা। কিছুদিন আগেও তাঁর একমাত্র ছেলে আমিনুল ইসলাম কিশোর ছিল। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ থেকে ছুটে আসা গুলির আঘাতে তার বয়স আজীবনের জন্য থেমে গেছে।

ওবায়দুল অটোরিকশা চালান। আর ১৬ বছর বয়সী ছেলে আমিন বৈদ্যুতিক সুইচ নির্মাণ কারখানার শ্রমিক। গত ২১ জুলাই রাজধানীর দনিয়া এলাকায় সংঘর্ষ চলছিল। সন্ধ্যায় ওই সড়ক দিয়ে অটোরিকশা নিয়ে যাচ্ছিলেন ওবায়দুল। তখন স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে সড়কের ওপর পড়ে থাকা এক কিশোরকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ডাক দেন। তিনি তড়িঘড়ি নিথর দেহটি অটোরিকশায় তোলার সময় দেখেন, এ তো তাঁর ছেলে। ছেলের গুলিবিদ্ধ নিথর দেহের ভার আর নিতে পারেননি বাবা। নিজে চালাতে পারেননি অটোরিকশা। পরে আরেকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ছেলেকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে আমিনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

‘যখন দেহি নিথর দেহটি আমার কলিজার টুকরার (ছেলে), তখনকার মনের অবস্থা কাউক বলে বোঝাতে পারুম না। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচমু? কার জন্য বাঁচমু? এখন বেঁচে থাকা না-থাকা সমান কথা।’ এভাবেই বলেছেন ওবায়দুল।

সন্তানের মৃত্যুর পর স্তব্ধ হওয়া বাবার হৃদয়ের ভেতর বাজা সকরুণ সুর কি আমরা শুনতে পাই? পারি না হয়তো। ধারণা করতে পারি, এই সুর যে শুনেছে তাঁর জীবন ও মৃত্যু নিয়ে তফাতের দ্বন্দ্ব মিটে যাবে। যেমনটা ওবায়দুলের কথায় টের পাওয়া যায়।

২০ জুলাই দুপুরে রাজধানীর চিটাগং রোড এলাকায় সংঘর্ষের সময় পপকর্ন ও চকলেট ফেরি করার জন্য বাসা থেকে বের হয় ১০ বছর বয়সী হোসেন মিয়া। মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে হবে। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত হোসেনের খোঁজ না পেয়ে বাসায় ছোট্ট দুই মেয়েকে ঘরে তালাবন্দী করে সন্তানের খোঁজে বের হন মা মালেকা বেগম ও বাবা মানিক মিয়া। অনেক পথ ঘুরে গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে ছোট্ট হোসেনের মরদেহ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বাবা মানিক।

নরসিংদী শহরের জেলখানার মোড়ে ১৮ জুলাই রাবার বুলেটের আঘাতে মারা যায় নবম শ্রেণিপড়ুয়া তাহমিদ ভূঁইয়া তামিম। সড়কে স্ট্রেচারে রাখা তাহমিদের লাশেও পরে গুলি লাগে। দূরে দাঁড়িয়ে তাহমিদের বাবা রফিকুল ইসলাম অসহায়ের মতো সে দৃশ্য দেখেছেন। তখন থেকেই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন তাহমিদের বাবা।

এমন অনেক বাবাই সন্তান হারিয়ে এখন স্তব্ধ হয়ে আছেন। অসহ্য ব্যথার মতো তাঁদের চোখের ভেতর জেগে আছে চিরদিনের ছুটি নিয়ে অনন্তে চলে যাওয়া সন্তানের মুখের আদল। সন্তান হারানো বাবারা তো বাজে পোড়া গাছ। তুমুল শ্রাবণও কি তাঁকে আর স্বাভাবিক করতে পারে!

আচ্ছা, ভাবনায় মানুষ কত দূর যায়? যত দূর তার কল্পনাশক্তি। কিন্তু বাবার সব কল্পনা তো সন্তানকে ঘিরে। সেই সন্তানের শয়নযান যদি বাবার কাঁধে ওঠে, তাহলে তো সবকিছু শূন্য হয়ে যায়। কোথায় রাখেন বাবা এতখানি শূন্যতা? এত এত সন্তানের মৃত্যু নিয়ে কী ভাবেন তিনি। দুরূহ স্তব্ধতা পেরিয়ে বাবারা বড়জোর বলতে পারেন যারা বেঁচে আছে, তারা যেন মা-বাবার কাছে ভরা নদী হয়ে ফিরে আসে সাবধানে।