কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশ হয়ে উঠেছিল উত্তাল। এই অস্থির সময়ে অনেক শিক্ষার্থীই হারিয়েছেন তাঁদের সতীর্থকে। পড়ুন এমনই একজনের শোকগাথা। মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর বন্ধু শাহিনুর রহমান চৌধুরী
দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ইয়ামিনের সঙ্গে আমার ভালোমতো পরিচয়। যদিও আগে থেকেই ওকে চিনি। আমার ফ্লোরেই থাকত, নামাজে দেখা হতো। কিন্তু আগে এত কথা হয়নি। ও থাকত ওর প্রোগ্রামিং আর গেমিং নিয়ে। আমি আমার কাজে। এরপর তো ওর সঙ্গে কথা বলা শুরু হলো। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি। তৃতীয় বর্ষে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা একই রুমে উঠব।
শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন ছিল মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। আমি ইলেকট্রিক্যাল ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন প্রকৌশল বিভাগে। ভীষণ পরোপকারী ছিল ইয়ামিন। পরীক্ষার আগের রাতেও কেউ সমস্যা নিয়ে এলে সময় দিয়ে সেটার সমাধান করে দিত। সারা দিন ল্যাপটপ নিয়ে থাকত। কিন্তু একবার ওর সঙ্গে আমার আড্ডা শুরু হলে চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আমার দেখা অনন্যসাধারণ মানুষদের মধ্যে একজন ইয়ামিন। শুধু ওর অ্যালার্মগুলো ছিল জঘন্য। ও বাদে রুমের সবার ঘুম ভেঙে যেত। চলাফেরা ছিল খুব সাধারণ। গেমিংয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল। বলত, এটা ওর ভাবনার সক্ষমতা বাড়ায়। ঘর থেকে খুব একটা বের হতো না। নিজের মতোই ল্যাপটপ নিয়ে থাকত।
চতুর্থ বর্ষেও আমরা একসঙ্গে উঠলাম। ওর সঙ্গে আমার চিন্তাভাবনার অনেক মিল ছিল। ও সব আমার সঙ্গে শেয়ার করত, আমিও আমার সমস্যাগুলোর কথা বলতাম। ইয়ামিনের কাছ থেকে সব সময় বাস্তবসম্মত (প্র্যাকটিক্যাল) উত্তর পেতাম। তাই ওকে বানিয়েছিলাম আমার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা।
কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক—এই জ্ঞান ছিল খুব ভালো। স্কুল-কলেজে সেরা ছাত্র ছিল। উচ্চমাধ্যমিকের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। বুয়েটে ভর্তি হয়নি, কারণ, ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ছাত্ররাজনীতি করতে চায়নি। তবে এমআইএসটি ডিবেট ক্লাব, সাইবার ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিল। প্রোগ্রামিংয়ে তুখোড় ছিল। কে কত দ্রুত রুবিকস কিউব মেলাতে পারি, এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। ইয়ামিন সব সময় আগে মিলিয়ে ফেলত। ইয়ামিনের আব্বু পড়ালেখার জন্য ওকে দেশের বাইরে পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে রাজি ছিল না। ইয়ামিন চাইত দেশেই কিছু করবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো। হল ছাড়ার নোটিশ এল। হল ছাড়ার আগমুহূর্তে গত ১৭ জুলাই ভোরে আমি, ইয়ামিন, পাশের রুমের নাহিদ, আরেক বন্ধু জিয়াউল কেন জানি না উচ্চ স্বরে আবৃত্তি করছিলাম কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা—
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির’
আমাদের শব্দে আশপাশের অনেকে চলে এসেছিল। কে জানত, এটাই ইয়ামিনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা! ১৮ জুলাই সকালেও ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। দুপুরে শুনি, আমার রুমমেট আর নেই। হাত কাঁপা শুরু করেছিল, সকালেই না ওর সঙ্গে কথা হলো! আমার চোখে ভাসতে লাগল ওর সঙ্গে কাটানো সময়গুলো। হারিয়ে ফেললাম আমার ভাইয়ের মতো বন্ধুকে, আমার রুমমেটকে।