আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলা পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করেছেন বাংলাদেশের দুই নারী রেফারি: ফুটবলে সালমা আক্তার আর টেনিসে মাসফিয়া আফরিন
স্কুলে পড়ার সময় সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সালমা আক্তার। ভাগ্যিস, সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছাটা বাদ দিয়ে খেলার মাঠে ছুটে গিয়েছিলেন! না হলে এমন কীর্তি কীভাবে গড়তেন? বাংলাদেশের প্রথম নারী রেফারি হিসেবে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) এলিট প্যানেলে জায়গা করে নিয়েছেন নেত্রকোনার মেয়ে সালমা। এর আগে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করেছেন, পেয়েছেন ফিফার সহকারী রেফারির স্বীকৃতি। এবার এএফসির এলিট প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হলেন। মালয়েশিয়ায় গত ১৬ থেকে ১৯ জানুয়ারি এএফসির এলিট প্যানেলের পরীক্ষায় অংশ নেন বাংলাদেশের দুই নারী রেফারি—জয়া চাকমা ও সালমা আক্তার। জয়া উত্তীর্ণ হতে পারেননি, কিন্তু সালমা পেরেছেন। ২০ ফেব্রুয়ারি পেয়েছেন সুখবর। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সালমাকে পার হতে হয়েছে পাঁচটি ধাপ। ফিটনেস টেস্ট, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, ভিডিও টেস্ট ও ম্যাচ পরিচালনা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফলতা দেখিয়েছেন সালমা।
অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজকের এ পর্যায়ে এসেছেন সালমা। শুরুতে যখন রেফারিং কোর্সের পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন, স্থানীয় অনেকেই বাধা দেন। শুরুর সেই গল্প সালমার মুখেই শোনা যাক, ‘২০১৩ সালে বাফুফে (বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন) নেত্রকোনায় ৭ দিনের একটা রেফারিং কোর্স করে। আমি ছিলাম ওই কোর্সের একমাত্র মেয়ে। আমাদের জেলা ক্রীড়া সংস্থার কেউ কেউ আমার অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অভিযোগ ছিল, রেফারিং কোর্সের জন্য আমার বয়স নাকি কম। শেষ পর্যন্ত কোর্সে অংশ নিয়ে পাস করি।’
সালমা বর্তমানে রাজধানীর বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল স্কুলের শারীরিক শিক্ষক। এএফসির এলিট প্যানেলের রেফারিং পরীক্ষায় পাস করতে অনুশীলনের সুযোগ খুব কমই পেতেন। সালমা বলছিলেন, ‘বেসরকারি স্কুলে চাকরি করি। ওখানে ৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া লাগে। স্কুলে সারাক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। বাচ্চাদের সঙ্গে প্রচুর কথা বলতে হয়, খেলতে হয়। ক্লান্তি ঘিরে ধরে তখন। এমনও দিন গেছে, রুটিনে অনুশীলন আছে, কিন্তু শরীর টানছে না। অনেক সময় জোর করেও অনুশীলন করেছি।’ অবশেষে পরিশ্রমের ফল পেয়ে উচ্ছ্বসিত সালমা, ‘অনেক কষ্ট করেছি। বিশেষ করে অনুশীলনের জন্য সময় বের করাটা কষ্টের হতো। দিনে সময় পেতাম না। যেখানে থাকি, সেখানে মাঠ নেই। তাই রাতে রাস্তায় অনুশীলন করতে হতো। এখন মনে হয় কষ্ট সার্থক হয়েছে।’
নেত্রকোনা আদর্শ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে যখন নবম শ্রেণিতে পড়তেন, তখন প্রথম অ্যাথলেটিকসে অংশ নেন সালমা। ১০০, ২০০ মিটার স্প্রিন্ট, লং জাম্প ও হাই জাম্পে নিয়মিত অংশ নিতেন। ২০০৮ সালে জাতীয় শিশু–কিশোর একাডেমির প্রতিযোগিতায় হাই জাম্পে ব্রোঞ্জও জিতেছিলেন তিনি।
স্টেডিয়ামে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবলও খেলতেন। কিন্তু নেত্রকোনা জেলা ফুটবল দল না গড়ায় ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়তে পারেননি। সালমাকে রেফারিংয়ে আগ্রহী করে তোলেন এএফসির রেফারি ফেরদৌস আহমেদ। ক্যারিয়ারে প্রথম ম্যাচে সালমা ছিলেন চতুর্থ রেফারি। সেদিন নেত্রকোনার জেলা লিগের পুরুষ ফুটবলের ম্যাচ পরিচালনা করেন। সেই স্মৃতি মনে হতেই হেসে ওঠেন সালমা, ‘প্রথম ম্যাচে ভয় লাগছিল না। তবে একটু নার্ভাস ছিলাম। মাঠে কেউ বিরক্ত করেনি। নারী হিসেবে নয়, রেফারি হিসেবেই আমাকে সম্মান করেছিল ছেলেরা।’
ব্যক্তিগত কারণে দুই বছর রেফারিং ছেড়ে দূরে ছিলেন। কিন্তু আবারও তাঁকে ফুটবল মাঠে নিয়ে আসেন রেফারি মাহমুদ জামাল ফারুকী। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরল সালমার কণ্ঠে, ‘নাহিদ (মাহমুদ জামাল ফারুকী) ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় আমি আবার অনুশীলন শুরু করি। দ্বিতীয়বারের মতো ফিফা রেফারি হওয়ার পরীক্ষা দিয়ে পাস করি।’
রেফারি হতে পরিবার কখনো বাধা হয়নি; বরং বাবা শহর আলী সব সময় সমর্থন জোগাতেন। ২০২১ সালে কিডনি রোগে ভুগে মারা যান বাবা। এমন সুখবর শুনে যেতে পারেননি বলে সালমার খুব আফসোস, ‘বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। পরিবারে আমার পছন্দের মানুষ ছিলেন বাবা। টিভিতে বা পত্রিকায় আমার ছবি দেখলে খুব খুশি হতেন। বলতেন, “আমার ছেলে যা পারেনি, মেয়ে হয়ে তুই তা করে দেখিয়েছিস।”
বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় তুলেছে, গত সেপ্টেম্বরে সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। রেফারিং দিয়ে দেশের পতাকা উঁচুতে তুলে ধরার স্বপ্ন দেখেন সালমাও, ‘স্বপ্ন দেখার শেষ নেই। ফুটবলে মেয়েরা এগিয়ে গেছে। আমার স্বপ্ন, এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের ম্যাচ পরিচালনা করা, দেশের পতাকা উঁচুতে তুলে ধরা। আসলে মুসলিমপ্রধান দেশের মেয়ে হয়ে রেফারিং করাটা খুব চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু ফুটবলের মতো রেফারিংয়েও বাংলাদেশের মেয়েরা যে পারে, সেটা দেখিয়ে দিয়েছি।’
নারী বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনার স্বপ্ন দেখেন সালমা, ‘সবে শুরু। এখনো অনেক দূর যেতে হবে। বিশ্বকাপে ম্যাচ পরিচালনা করতে চাই।’