বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামছুন্নাহার নাহিদ ও ‘নকশা’র নিয়মিত রন্ধনশিল্পী ফারাহ্‌ সুবর্ণা
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামছুন্নাহার নাহিদ ও ‘নকশা’র নিয়মিত রন্ধনশিল্পী ফারাহ্‌ সুবর্ণা

খরচ কমিয়ে ৭ দিনই যেভাবে পুষ্টিকর খাবার খাবেন

বাজারদরে পেরে না উঠে অনেকেই রোজকার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ রাখছেন ডিম, দুধ বা মাছ–মাংসের মতো পদ। দিন শেষে তাই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে খাবার থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি মিলছে কি না। এই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েই বারডেম জেনারেল হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ শামছুন্নাহার নাহিদ ও ‘নকশা’র নিয়মিত রন্ধনশিল্পী ফারাহ্‌ সুবর্ণাকে এক টেবিলে বসিয়েছিল ‘অধুনা’। দামি খাবার বাদ দিয়েও কীভাবে প্রতিদিনের পুষ্টিটা ঠিক রাখা যায়, সেই পরামর্শই দিয়েছেন তাঁরা। একই সঙ্গে চারজনের একটি পরিবারের সাত দিনের খাবারের তালিকা কেমন হতে পারে, তারও একটি নমুনা তৈরি করে দিয়েছেন তাঁরা। এই তালিকা তৈরিতে প্রতিদিনের পুষ্টি ও সাশ্রয়ী উপাদানগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

প্রতিদিন কতটা পুষ্টি দরকার

শামছুন্নাহার নাহিদ: পুষ্টি নির্ভরই করে বয়সের ওপর। একটি পরিবারে যদি চারজন মানুষ থাকেন, তাহলে তাঁদের বয়স নিশ্চয়ই এক হবে না। কেউ হয়তো প্রাপ্তবয়স্ক, কারও আবার বাড়ন্ত বয়স। থাকতে পারেন প্রবীণ সদস্যও। তাই সরাসরি চারজন বলে পুষ্টির পরিমাণ বোঝানো কঠিন। একই সঙ্গে মানুষগুলোর বয়স, ওজন, উচ্চতা—নানা কিছু নির্ভর করে। তবে আমরা যদি সামগ্রিক দিক বিবেচনায় নিয়ে একটা ধারণা দিতে চাই, তাহলে বলতে হবে, একই রান্নায় কীভাবে সেই পুষ্টির চাহিদা মিটবে। প্রথমত, মানুষটির জন্য শর্করা (কার্বোহাইড্রেড) জরুরি। যা মিলবে চাল, আটা থেকে। এরপর দরকার প্রোটিন। যা দুই ধরনের উপায়ে মিলবে—১. প্রাণিজ প্রোটিন ২. উদ্ভিজ্জ প্রোটিন। তবে প্রাণিজ প্রোটিন খেতে পারলে সবচেয়ে ভালো, সেটা অল্প পরিমাণে খেলেও ভালো কাজ করে। এর মধ্যে আছে ডিম, দুধ, মাছ, মাংস ইত্যাদি। তবে কম খরচে মেলে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন। যেখানে নন–এসেনশিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিড অনেক বেশি, তবে এসেনশিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিডের একটু ঘাটতি থাকে। ফলে আমরা যদি উদ্ভিজ্জ প্রোটিন খেতে চাই, তাহলে ডাল, ছোলা, বুট, বাদাম থেকে সহজে মিলতে পারে এই প্রোটিন। এবার আসি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান চর্বি (ফ্যাট) বিষয়ে। আলাদা করে যেটা খাওয়ার দরকার পড়ে না। শুধু খাবারে প্রতিদিন যে তেল খাচ্ছি, সেটা থেকেই এই উপাদানটি শরীর পেয়ে যেতে পারে। এরপর আছে ভিটামিন ও মিনারেলস, যা আগের খাবারগুলো খাওয়ার পর শরীরে সেটা শোষণ ও হজম এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য দরকার। এটা লাগে খুবই কম, কিন্তু প্রতি বেলায় জরুরি। শাক, সবজি, ফলমূল বা সালাদ থেকে এটা সহজেই পেতে পারে শরীর।

প্রতিদিনের খাবারে কোনো পুষ্টি বাদ না দিয়েও খরচ কমাতে পারবেন রান্নায়। মডেল: হৃদি

কারও যদি সামর্থ্য না থাকে, সব কটি উপকরণ দামি খাওয়ার কোনো দরকার নেই। প্রতিদিন যে শর্করা দরকার, সেটা ভাত বা রুটি ছাড়াও চিড়া, মুড়ি, নুডলসের মতো উপকরণ থেকেও মিলতে পারে। প্রোটিন মানেই যে মাছ–মাংস খেতে হবে, সেটা নয়। সবচেয়ে কম খরচে বেশি প্রোটিন মেলে ডিম থেকে। ডিমের দামও বেশি, কিন্তু মাছ বা মাংসের তুলনায় এখনো কম। ১৩ টাকা একটা ডিমের দাম হলে চারজনের পরিবারের জন্য খরচ ৫২ টাকা। এই ৫২ টাকায় এত ভরপুর প্রোটিন আর কিছুতে পাওয়া কঠিন। তাই প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে ডিম একটি ভালো খাবার।

পাশাপাশি শাকসবজি অথবা সালাদের যেকোনো একটা কম খরচে সারতে চেষ্টা করুন। যেটা কম দাম, সেটাই কিনুন। এবার ধরুন ডালটা বাদ যাচ্ছে বা পদ বেশি রান্না করতে গিয়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে চারটি পদকে দুই পদে নামিয়ে এনে রান্নায় কৌশলী হতে চেষ্টা করুন। ধরুন, আপনি সবজি দিয়ে মাছ রান্না করলেন আর ডাল দিয়ে রান্না করলেন শাক। এতে দুই পদ রান্না করেও সহজে পেতে পারেন চার ধরনের পুষ্টি। পাশাপাশি ভিটামিন সি রোজ খেতে চেষ্টা করুন। সেটা কমলা, মাল্টা খেয়ে পূরণ না করে প্রতিদিনের খাবারে কাঁচা মরিচ, লেবু, ধনে পাতা ইত্যাদি রেখে সেখান থেকেও মেটাতে পারেন।

তিনবেলাই খাবেন, নাকি বেশি

পুষ্টিবিদের পরামর্শ হলো তিনবেলার বাইরে আরও এক-দুবেলা কিছু খাওয়া। সেটা দুপুর বা রাতের মতো ভারী খাবার না, নাশতা। একটা কলা, একটা পেয়ারা বা অন্য কোনো দেশি মৌসুমি ফল থেকেও পূরণ হতে পারে এই চাহিদা। একদিন হয়তো খেলেন এক বাটি সেদ্ধ ছোলা, কখনো নুডলস বা এক গ্লাস দুধ। এতেই শরীর ঠিক থাকবে। বাসায় যদি বাড়ন্ত বয়সের শিশু থাকে অর্থাৎ ১৮ বছরের কম বয়সী, তা হলে তার দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখুন। তার মেধা ও শরীরিক বিকাশের জন্য কিছুটা বাড়তি খাবার জরুরি।

খরচ কমাতে কী করা

ফারাহ্‌ সুবর্ণা: দুইবেলার খাবার একসঙ্গে রান্না করলে নানা দিক থেকে কমে যাবে খরচ। সময় ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে। কিছু খাবার যেমন সাত দিনের একসঙ্গে কিনে নিতে পারেন, কিছু খাবার কেনা দরকার হতে পারে দুই দিন পর পর। তবে বাজার করার আগে যদি পদগুলো ঠিক করে নিতে পারেন, তাতে কেনাকাটার বাড়তি খরচ এড়ানো সহজ হবে। যাঁদের বাসায় ফ্রিজ আছে, তাঁরা দু–তিন দিনের রান্না একবারে করেও ফ্রিজে রাখতে পারেন। এতে খরচ আরও কম হবে।

আলাদা আলাদা বক্সে ভরে খাবার রাখুন ফ্রিজে

অনেকে মনে করেন, ফ্রিজে রেখে খেলে খাবারের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। এই বিষয়ে পুষ্টিবিদের পরামর্শ হলো—খাবার কীভাবে সংরক্ষণ করছেন, তার ওপর মান ঠিক থাকা না–থাকা নির্ভর করে। তাই ঠিকভাবে রান্না ও সংরক্ষণ করা হলে দু–তিন দিনে খাবারের মানে খুব একটা হেরফের হয় না। রান্নার পর খাবার ঠিকমতো ঠান্ডা করে, আলাদা আলাদা পাত্রে ঠিকমতো ঢেকে রাখলে মান ঠিক থাকবে। এখানে অবশ্যই খাবার ঠিকমতো ঢেকে রাখতে হবে। এতে বরং তেল–মসলার খরচ অনেকটা বেঁচে যাবে। সময়ও কম নষ্ট হবে।

প্রতিদিন মাংস বা মাছ না খেয়ে সাত দিনে দুই দিন মাছ রাখুন, একবেলা মাংস, দুই দিন ডিমসহ অন্য কিছু রেখে যদি বাজার করা হয়, তাতেও খরচ কমানো সম্ভব। মোটকথা, সপ্তাহের শুরুতেই আপনাকে হিসাব করে ফেলতে হবে আপনি এই সাত দিন কী কী রাঁধবেন। এরপর কোন বেলার জন্য কতটা উপকরণ দরকার হতে পারে, আন্দাজ করে সেটুকুই বাজার করুন। অনেক সময় আমার দরকার হয়তো দুটি বেগুন, অযথা এক কেজি কিনে আনার দরকার নেই। অথবা চল্লিশ টাকার বাজারের পর অনেক সময় দোকানি ‘৫০ টাকার মিলায়ে দিই’ বলে বাড়তি দিয়ে দেন। এসব ক্ষেত্রে বিনয়ের সঙ্গে ‘না’ বলতে শিখুন।

খাবার নিয়ে সন্তানদের নানা রকম বায়না থাকে। অনেকে আছেন, ‘মাছ খাই না’ বলে এড়িয়ে যান। তাঁদের খাওয়ানোর জন্য কিছুটা ভিন্নভাবে রান্নার চেষ্টা করুন। রুই–কাতলার ঝোল খেতে না চাইলেও তেলাপিয়ার গ্রিল ঠিকই পছন্দ করবে। এতে তেলাপিয়া মাছ কেনায় বরং খরচ আপনার কিছুটা কম হবে। উপকরণেও বাড়তি খরচ হবে না।

চারজনের সাত দিনের বাজার

টাকাপয়সার টান থাকলে একসঙ্গে মাসের বাজার করা অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই কিছু উপকরণ যদি এক সপ্তাহের জন্যও কিনে রাখতে পারেন, তাতে সংসারে সাশ্রয় হবে। রন্ধনশিল্পী ও পুষ্টিবিদ মিলে এখানে যেমন একটা হিসাব দিলেন—চাল ৪ কেজি, আটা ২ কেজি, তেল ১ লিটার, চিনি ২০০ গ্রাম, ডাল ১ কেজি, পেঁয়াজ ১ কেজি, আদা ২০০ গ্রাম, রসুন ২৫০ গ্রাম, লবণ ২৫০ গ্রাম, আলু ১ কেজি, ডিম ২৮টি ও গুঁড়া দুধ ৩০০ গ্রাম। এই উপকরণগুলো একবারে কিনে ফেলতে পারলে সপ্তাহের জন্য নিশ্চিত থাকতে পারবেন। কেউ কেউ এসব বাজার এক মাসের জন্য একবারে করে নেন, তাতে আরও সাশ্রয়।

এ ছাড়া মাছ, মাংস, সবজি, শাকের মতো কাঁচাবাজার করুন মিলপ্ল্যান ঠিক করে। এসব ক্ষেত্রে মাছ কিনলে হয়তো, দুইবেলার কথা ভেবে পরিমাণ ঠিক করে নিলেন। মাছের মাথা ও লেজ দিয়ে হয়তো আরেক বেলা অন্য কোনো পদ রাঁধলেন। অনেক সবজির খোসা খাওয়া যায়। লাউ দিয়ে যদি মাছ রান্না করেন, লাউয়ের খোসা দিয়ে ডিম বা আলু যোগ করে একটা ভাজি করতে পারেন। এভাবে পরিকল্পনা করতে হবে।

কবে কী রান্না করবেন সেই পরিকল্পনা আগে করে রাখুন

কোন বেলায় কী রান্না

সাত দিনের খাবারে যাতে একঘেয়েমি না আসে, এমনভাবে বুদ্ধি করে পদ নির্বাচন করুন। আপনার পরিবারে কে কী খেতে ভালোবাসে, সেটা আপনিই ভালো বুঝবেন। এরপরও এখানে রান্নাবিদ এক সপ্তাহের একটা মিল প্ল্যান দিয়েছেন, যাতে পুষ্টি ও সাশ্রয়—দুটিই মিলবে।

সাত দিনের সকালের নাশতায় থাকতে পারে রুটি, ভাজি, ডিম বা ডাল। একদিন একেকভাবে রান্না করলে স্বাদ নিয়ে ভাবনা থাকবে না। বেশির ভাগ বাড়িতে দুপুর ও রাতের রান্না একবারে করে ফেলা হয়। এতেও খরচ কমে। সেই হিসাবেই দুপুর ও রাতের দুবেলায় মুল খাবার যেমন হতে পারে—

শনিবার: ভাতের সঙ্গে একটা ভর্তা রাখতে পারেন। আলু, বেগুন, কচু, ডাল ইত্যাদি ভর্তা খেতে পারেন। ভর্তায় পটোল, মিষ্টিকুমড়া বা লাউয়ের খোসাও রাখতে পারেন। মাছের ঝোল বা ভুনা, ডাল রাখুন। মাছের সঙ্গে যদি সবজি দিয়ে ঝোল করেন, তাহলে তার খোসা দিয়ে সেদিন ভর্তাটা করতে পারেন।

রোববার: ভাত, কলমিশাক ভাজি, কাঁচকলা দিয়ে কই মাছের ঝোল ও ডাল। রাতে কেউ চাইলে রুটি খেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে একটা ভাজি রাখতে পারেন।

সোমবার: ভাত বা রুটি। ঢ্যাঁড়সভাজি, ব্রয়লার মুরগি দিয়ে আলুর ঝোল অথবা মুরগি দিয়ে মুগডাল।

মঙ্গলবার: ভাত, লালশাক ভাজি, পাঙাশ মাছ আলু দিয়ে রান্না বা ভুনা ও পাতলা ডাল।

বুধবার: ভাত, কচুরমুখি ভর্তা, মাছভাজা ও ডাল। একবেলা রুটি হলে সঙ্গে রাখতে পারেন পেঁপে দিয়ে মসুর ডালের সবজি।

বৃহস্পতিবার: ভাত, আলু–করলা ভাজি, পাবদা মাছ ও পাতলা ডাল।

শুক্রবার: খিচুড়ি বা ভাতের সঙ্গে পটোলভাজা, মুরগি বা গরুর একটি পদ ও ডাল।

প্রতি বেলা খাবারের সঙ্গে লেবু বা কাঁচা মরিচ নিশ্চিত করুন। এতে দরকারি ভিটামিন সি শরীরে যাবে। পটোল ও মিষ্টি কুমড়ার খোসাও ভাপ দিয়ে রেখে প্রয়োজনমত ভর্তা করে খেতে পারেন।