‘ছুটির দিনে’ যে পড়বে, তাকে জোরে জোরে পড়তে হবে

বুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলে বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর ১৯৯৮ সাল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে কোচিং করতে বন্ধুরা সবাই ঢাকা চলে গেল। সামর্থ্যে কুলাল না বলে আমি কুষ্টিয়াতেই থেকে গেলাম। বন্ধু শাহেদ নিয়ম করে তখন সপ্তাহান্তে কোচিংয়ের লেকচার শিটগুলো আমার জন্য ফটোকপি করে ডাকে পাঠিয়ে দিত। আমি যতই সেগুলো দেখতাম, ততই তলিয়ে যেতাম। এত কঠিন প্রশ্ন হলে তো আমি পারব না। কিন্তু বড় ভাইদের দেওয়া কোচিংয়ের পুরোনো গাইড বই আবার আশা জাগায়। সেখানে দেখি বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন আবার তত কঠিন নয়। সে এক দোদুল্যমান সময়। অবশেষে বন্ধুরা বুদ্ধি দিল, অন্ততপক্ষে শেষের দিকে কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে মডেল টেস্টগুলো দিতে।

সেই মোতাবেক একদিন বাক্সপেটরা নিয়ে ঢাকায় বন্ধু সালামদের মেসে হাজির হলাম। তারপর একটা কোচিং সেন্টারের ফার্মগেট শাখায় ৫০০ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম।

ঢাকাতে তখন আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবন। এর মধ্যে একটা ঘটনা আমাদের মধ্যে প্রচণ্ডরকম আলোড়ন তুলল। প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’তে আমাদের বন্ধু পাভেলের একটা লেখা ছাপা হয় ‘স্যার বলতে লজ্জা লাগে’ শিরোনামে। একজন চেনা মানুষের লেখা জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া আমার জন্য ছিল প্রচণ্ডরকম আনন্দের। সেটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল আমাদের কুষ্টিয়া কলেজের স্যারদের মধ্যেও।

এরপর একসময় ভর্তি পরীক্ষার ধাপ পার হয়ে বুয়েটে ভর্তি হলাম। ড. এম এ রশীদ হলে আমার সিট পড়ল। আমাদের ফ্লোরে প্রথম আলো রাখা হয়। প্রথম আলো তখন বিভিন্ন দিন বিভিন্ন ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে যাচ্ছে। শনিবার সকালে সবাইকে দেখি মূল পত্রিকা বাদ দিয়ে সেদিনের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ নিয়ে টানাটানি করে। ফ্লোরে আমাদের উইংয়ে কক্ষ ছিল ছয়টি। পত্রিকা কখনো বারান্দায় দল বেঁধে পড়া হতো, আবার কখনো এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরত। তখন সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন—শুক্র ও শনিবার। ছুটির দিন সকালে আমরা সবাই হলেই থাকতাম। তাই বারান্দায় দল বেঁধে মূল পত্রিকার সঙ্গে ‘ছুটির দিনে’ ম্যাগাজিনও পড়া হতো। কিন্তু ‘ছুটির দিনে’ যে পড়বে, তাকে জোরে জোরে পড়তে হবে। যাতে সবাই শুনতে পায়।

‘ছুটির দিনে’র বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে পাঠকের লেখা অংশটা ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয়। সেখানে অনেক রকমের লেখা থাকত। সেই লেখাগুলোর আকার ও বিষয়বস্তু ছিল আকর্ষণীয়। শনিবারের ছুটির দিনে পড়া হতো সপ্তাহজুড়েই। একজনের হাত থেকে অন্যজনের হাতে, এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ‘ছুটির দিনে’ ঘুরতে থাকত। প্রতিদিনের পত্রিকা দিন শেষে খাটের তলে আশ্রয় নিলেও ‘ছুটির দিনে’ থেকে যেত বিছানার বালিশের তলে, পড়ার টেবিলে। মাস শেষে পুরোনো পত্রিকা সের দরে বিক্রি করে দিলেও ‘ছুটির দিনে’ আমরা সযত্নে রেখে দিতাম। কখনো কোনো উপলক্ষে শনিবার সকালে ‘ছুটির দিনে’ প্রকাশ না হলে আমরা হতাশ হতাম। অনেক সময় দেখা যেত হকার পত্রিকা দিয়ে গেছে কিন্তু ভেতরে ‘ছুটির দিনে’ নেই, আমরা কেউ দেখার আগেই চুরি হয়ে গেছে।

নিজেদের ইংরেজিতে দক্ষ করতে আমরা একসময় ইংরেজি পত্রিকা রাখা শুরু করলাম কিন্তু তখনো শনিবার আর সোমবার রাখা হতো প্রথম আলো। কারণ, ‘ছুটির দিনে’ আর সোমবারের ‘আলপিন’।

একসময় প্রবাসী হয়ে গেলাম। অনলাইনে পত্রিকা পড়ি। তবে দেশে গেলে প্রিন্ট পত্রিকা কিনে পড়ি। অন্যদিন না কিনলেও শনিবার অবশ্যই কিনি। কারণ, ‘ছুটির দিনে’। এখানে যেমন পেয়েছি পাঁচমিশালি লেখার স্বাদ, তেমনি তৈরি হতে দেখেছি নতুন লেখক। আমিও নিজের জীবনের ঘটনা ‘ছুটি দিনে’তে লেখার বাসনা পুষে রেখেছিলাম দীর্ঘদিন। একবার সে সুযোগও চলে এল। ‘মা দিবস’ উপলক্ষে পাঠানো লেখা ছাপা হলো। সেই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর দেশ থেকে অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা পেয়েছি।

আসলে নিজের নামটা ছাপার অক্ষরে দেখার মধ্যে অকৃত্রিম ছেলেমানুষি আনন্দ আছে। ‘ছুটির দিনে’ আমাকে সেই আনন্দ দিয়েছে।