আইয়ুব বাচ্চুর ‘বেইলি রোড’ গানটা শুনেছেন?
কাকরাইল পার হয়ে
শান্তিনগরের চৌরাস্তা থেকে প্রথম বাঁয়ে
এসে গেছি আমি বেইলি রোডে
বেইলি রোডে ঢুকলেই চোখে পড়ে গার্লস স্কুল
দোকানে সাজানো আছে বিক্রির ফুল
মিস্টার বার্গার সিঁড়িতে আড্ডা
মারুফ, রবি আর সুজয় ওরা
মামার পেঁয়াজু জুড়ে প্রচণ্ড ভিড়
সস্তা খাবারেই স্বপ্নের নীড়
তাঁতের শাড়ি বুঝি শেষ নেই দেশে
দুইতলা-তিনতলা শাড়ির দোকানে, আহ্
সুইস প্লাসে একটু ঢুঁ মেরে দেখি
কমপিটিশন চলে কে বেশি সুন্দরী
সাগর পাবলিশার্সে কে বেশি ঢোকে
কেউ কেউ অকারণে ঘোরাঘুরি করে
মনে হয় সর্বদা উৎসব চলে
শান্তিনিকেতনী ব্যাগ কারও কাঁধে
আর্ট-কালচার সব যেন এইখানে
নাটক দলের সব কর্মীর ভিড়ে
আসলে ওরা সবাই ব্রড মাইন্ডেড
ডেটিংয়ের অপেক্ষায় লাইফ অর ডেড
ইউরো হাটের কেনা চিকেন ফ্রাই
টিন্টেড লেন্সারে বসে চলো খাই।
আইয়ুব বাচ্চুর সেই বেইলি রোড আর নেই। বদলে গেছে আমূল। ছোট বাড়িগুলো নেই। নেই পরিচিত সব দোকান। টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য বিখ্যাত এই রাস্তা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শাড়ির দোকান। বহুতল ভবন হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক।
এই যে সাগর পাবলিশার্সের কথা বলা হলো, সেই দোকানটাও ধুঁকছে। প্রতিদিন এখন আর খোলাও হয় না। কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, সেখানেও উঠবে বহুতল ভবন। ‘চরমপত্র’খ্যাত এম আর আখতার মুকুল ছিলেন এই সাগর পাবলিশার্সের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকেও দোকানে বসতে দেখতাম। আসতেন কত গুণীজন। গুলজার হতো আসর। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে দেখভাল করতেন।
আইয়ুব বাচ্চু যথার্থ ধরেছেন, বেইলি রোডে জনপ্রিয় ছিল তাঁতের শাড়ি। বিশেষ করে টাঙ্গাইল শাড়ি। পথিকৃৎ অবশ্যই মনিরা এমদাদ। তিনিই ১৯৮২ সালে একটি টিনশেডে এই দোকান শুরু করেছিলেন। এক বছর পর তাঁরা বাড়ি করলে তিনি পাকাপাকিভাবে বেইলি রোডে থাকা শুরু করেন। আর টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরও একটা স্থায়ী ঠিকানা পায়। তাঁতের শাড়ির প্রতি অনুরাগ থেকে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান আজও তিনি টিকিয়ে রেখেছেন পরম মমতায়। তবে তাঁর অবর্তমানে কে হাল ধরবে, তা নিয়ে তিনিও যে চিন্তিত নন তা নয়।
সেই কবে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর (১৮৭৯-১৮৮২) স্যার স্টুয়ার্ট বেইলির নামানুসারে এই রাস্তার নাম হয় বেইলি রোড। ২০০৫ সালের ২৬ আগস্ট তদানীন্তন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এই রাস্তার নাম বদলে রাখেন নাটক সরণি। তবে মানুষের মুখে মুখে এখনো বেইলি রোডই থেকে গেছে। সেই আশির দশকে এই রাস্তায় হাতে গোনা কয়েকটা দোকান ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল ফটোমেটিক নামে ফটো স্টুডিও; অন্যটি জেসমিন কনসোর্টিয়াম, একটি কসমেটিকসের দোকান। আশির দশকের শুরুতে হয় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। এরপর কন্টিনেন্টাল ডিপার্টমেন্ট স্টোর।
জেসমিন কনসোর্টিয়াম এখন আর নেই। তবে সাদা দোতলা বাড়িটি আছে। এরই তিনতলায় একসময় ছিল প্রাইডের একটি শোরুম। দোতলায় পারফেক্ট টেক্সটাইল। পরে হয়েছিল ইত্যাদি। বর্তমানে সেটাই এম ক্র্যাফট। এ ছাড়া আছে রূপের হাটসহ গোটা কয়েক দোকান। এই জেসমিন কনসোর্টিয়ামের প্রোপার্টির মালিক আসলে ইস্পাহানিরা। কিন্তু বেদখল এই সম্পত্তি দখলে পাওয়ার জন্য তাঁদের মামলা লড়তে হয়েছে ৫৫ বছর।
বেইলি রোডের মূল আকর্ষণই আসলে টাঙ্গাইল শাড়ি। আগেই বলেছি, মনিরা এমদাদের হাত ধরে যার সূচনা। বছর কয়েক পর তাঁর দেখাদেখি আরেকটি শাড়ির দোকান হয়। নাম তাঁতঘর। এই একই প্রতিষ্ঠান পরে তিনটি শাড়ির দোকান করে—ঝলক, পলক ও নোলক। এর মধ্যে যৌথ মালিকানা থাকায় তাঁতঘর একসময় বন্ধ হয়ে গেলে তাঁতসম্ভার নামে নতুন দোকান চালু করে এক পক্ষ। পলক এখনো আছে। তবে সেটা বহুতল স্থাপনা কাশেম প্যারাডাইসের মধ্যে। কিন্তু আগের সেই অবস্থা আর নেই।
প্রথম এখানে ফ্যাশন হাউসের আউটলেট করে কে ক্র্যাফট। সেখানেও ছিল বেইলি রোডের আবহের সঙ্গে খাপ খাইয়ে পণ্যসম্ভার উপস্থাপনের চেষ্টা। তাই শাড়ি এই আউটলেটে পেয়েছে আলাদা গুরুত্ব। এমনকি বিভিন্ন দেশি অনুষ্ঠান আর উপলক্ষ উদ্যাপন করা হয়েছে। পরে অনেক ব্র্যান্ড গেছে। কেউ আবার চলেও গেছে।
৮০ থেকে ৯০ পর্যন্ত বেইলি রোডে অন্তত ২০টা তাঁতের শাড়ির দোকান হয়েছে। শাড়ির দোকান এখন হাতে গোনা যাবে। কারণ, বহুতল ভবন হচ্ছে একের পর এক। নতুন এসব স্থাপনা চলে যাচ্ছে শাড়ির উদ্যোক্তাদের নাগালের বাইরে। বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে জায়গা নিয়ে তাদের পক্ষে আর শাড়ির দোকান করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং নগরবাসীর ট্রেন্ড এখন রসনাবিলাস। তাই নতুন কোনো ভবন উঠতে শুরু করলে রেস্তোরাঁওয়ালারাই সবার আগে এসে জায়গা বুক করছেন। সম্প্রতি টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের পাশের জায়গায় থাকা দোকানগুলো উঠিয়ে বহুতল ভবন করার কাজ শুরু হয়েছে। নতুন বিল্ডিংয়ে রেস্তোরাঁ করার জন্য এরই মধ্যে নাকি বায়না করছেন আগ্রহীরা। এভাবে ক্রমে শাড়ি আর নাটকের পরিবর্তে খাবারের জন্য পরিচিত হয়ে উঠছে বেইলি রোড। হালের প্রজন্ম হয়তো জানতেই পারবে না একসময় এই রাস্তার জনপ্রিয়তার কারণ।
একাধিক বয়ন উদ্যোক্তাও আজ স্মৃতিমেদুর। অনেক কষ্ট করে তাঁরা ঢাকায় আসতেন। রঘুনাথ, সুরেশ, রতন ও মানিক—এই চার বসাকভাই তখন একসঙ্গে ব্যবসা করতেন। মনিরা এমদাদের সঙ্গে লেনদেনটা করতেন সুরেশ বসাক। পরে তিনি ভারতে চলে গেলে হাল ধরেন রঘুনাথ। তাঁদের ছোট ভাই মানিকও ভারতে চলে যান। রঘুনাথ ও রতন পরে আলাদা হয়ে গেলেও টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কখনোই ছিন্ন হয়নি। তিনি ছাড়া আরও শাড়ি দিতেন সুশীল বসাক। টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির ছাড়া অন্য কাউকে তাঁরা শাড়ি দিতেন না। দিদিমণির (মনিরা এমদাদ) প্রতি তাঁর আনুগত্য ও ভালোবাসা আজও অব্যাহত আছে। অনেক কষ্ট করে তাঁরা তখন ঢাকায় আসতেন। অনেক সময় মগবাজারে শাড়ি ছিনতাইও হয়ে যেত। এ ছাড়া অন্য বয়নশিল্পীরা অন্যান্য দোকানে শাড়ি দিতেন। এখনো হয়তো দেন। কিন্তু কমে এসেছে বেইলি রোডে তাঁদের ব্যবসা। যত দিন যাচ্ছে, উঠে যাচ্ছে দোকান। কমছে ক্রেতা।
এভাবেই হয়তো একদিন শাড়ির দোকানশূন্য হয়ে যাবে বেইলি রোড। শুধু `বেইলি রোড' গানে থেকে যাবে স্মৃতি।
তথ্যসূত্র: মনিরা এমদাদ, কে বি আল আজাদ, খালিদ মাহমুদ খান, মো. মাঈন উদ্দীন, রঘুনাথ বসাক ও সুশীল বসাক