উচ্চশিক্ষার জন্য যদি জাপানে যেতে চান

বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীই পড়ালেখা কিংবা গবেষণার জন্য যাচ্ছেন সূর্যোদয়ের দেশ—জাপানে। সেখানে পড়ালেখার সুযোগ-সুবিধা কেমন? খোঁজ নিয়েছিলাম আমরা।

জাপানে পড়ছেন বহু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী

১. স্নাতকের জন্য কি আবেদন করা যায়?
টোকিও ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আমিমুল এহসান খান। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়ছেন। বললেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী জাপানে স্নাতক পর্যায়ে পড়তে আসেন। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করেই জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি আবেদন করা যায়।’ বাংলাদেশে অবস্থিত জাপানের দূতাবাসের মাধ্যমে আবেদন করা যায়। জাপানের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও বৃত্তির সুযোগ আছে। আরও জানা যাবে এই ওয়েবসাইটে

২. বৃত্তির সুযোগ কেমন?
মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে বৃত্তির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিষয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শমিত দাশগুপ্ত জানান, জনপ্রিয় বৃত্তিগুলোর মধ্যে মেক্সট বৃত্তি উল্লেখযোগ্য। গবেষণার মাধ্যমে অন্যান্য দেশের সঙ্গে জাপানের বন্ধুত্ব বিকাশের জন্য এ বৃত্তি দেওয়া হয়। এই কর্মসূচির অধীন বৃত্তিপ্রাপ্তদের শিক্ষার্থীদের কোনো টিউশন ফি বা ভর্তি ফি দিতে হয় না। থাকা–খাওয়ার খরচ, আসা-যাওয়ার বিমানভাড়াও বৃত্তির অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া জাপানের ‘এডিবি-জাপান স্কলারশিপ প্রোগ্রাম’–এ শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি ছাড়া পড়ার সুযোগ পান। জীবনধারণ, বাড়িভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ, বই এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার খরচ, চিকিৎসা বিমা, ভ্রমণের খরচ—সবই থাকে বৃত্তির আওতায়। আরেকটি জনপ্রিয় বৃত্তি হলো জাপান-বিশ্বব্যাংক বৃত্তি। এর মাধ্যমে মাস্টার্স, পিএইচডি ডিগ্রিসহ নানা প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল ও কাজের জন্য নানা ধরনের বৃত্তি ও আর্থিক প্রণোদনা পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অফিসে ই-মেইল করে এসব বৃত্তি ও ফেলোশিপের সুযোগ সম্পর্কে জানা যাবে।

৩. বৃত্তির জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে?
জাপানের পড়াশোনার পরিবেশ প্রতিযোগিতামূলক ও সৃজনশীল। জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে দুই সেমিস্টারে বিভিন্ন বৃত্তি ও ফেলোশিপ নিয়ে ভর্তি হওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ডা. রেহনুমা হক। জাপানের কাগোশিমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন তিনি। তিনি জানান, বৃত্তি পেতে হলে ভালো স্কোর থাকতে হবে, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হতে হবে। মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে পড়ার জন্য পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। বৃত্তির জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সনদপত্রের পাশাপাশি ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাস’, গবেষণা করতে কেন আগ্রহী—এসব নিয়ে অনুচ্ছেদ লিখতে হয়। এ ছাড়া আগের গবেষণার অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সনদও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়।

৪. জাপানের পড়াশোনা ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কেমন?
গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক বৃত্তি হলো ‘এডিবি-জাপান স্কলারশিপ প্রোগ্রাম’। এশিয়া মহাদেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বিকাশে বৃত্তিটি দেয় জাপান ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। এই বৃত্তি নিয়ে পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রকৌশল বিদ্যাপীঠ টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন মাসরুফ হোসেন। তিনি বলেন, জাপানে পড়াশোনার পরিবেশ আলাদা। মেধার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পরিশ্রমকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা দিনরাত গবেষণা ও পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ভবিষ্যতের উন্নত পৃথিবী গড়তে যত ধরনের গবেষণা হওয়া প্রয়োজন, সবকিছুই চলছে। জাপানের পড়াশোনার অন্যতম একটি দিক হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্পর্ক। একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে হাজারবার জানতে চাইলেও শিক্ষকেরা বিনা দ্বিধায় বুঝিয়ে দেন। রেহনুমা হক জানান, জাপান থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও গভীর পড়াশোনা ও গবেষণার সুযোগ থাকে। জাপানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শিক্ষক ও গবেষক যুক্ত আছেন। তাই পড়াশোনার মান ও পরিবেশ গবেষণামুখী ও আধুনিক।

৫. জাপানে পড়তে হলে জাপানি ভাষা কি শিখতেই হয়?
জাপানি ভাষা জানলে স্বাভাবিকভাবেই সুযোগ বেশি পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পোস্টডক্টরাল রিসার্চার ড. ফেরদৌস আরা। তিনি তোহুকু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন ২০১৯ সালে। পরে পোস্টডক করেছেন আরও আড়াই বছর। তিনি বলেন, স্নাতক পড়ার সময় জাপানি ভাষা জানতে হবে। মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে ইংরেজি ভাষায় পাঠ্যক্রম থাকার কারণে জাপানি ভাষা না জানলেও খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয় না। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জাপানি ভাষা শেখার সুযোগ অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই থাকে।

৬. জাপানে জীবনযাত্রার ব্যয় কেমন?
জাপানের শহরগুলোয় জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত। রেহনুমা হক বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। তবে অনেক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আছে। জাপানে বৃত্তি নিয়ে পড়ার সময় আমরা নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি।’ মাসরুফ হোসেন বলেন, ‘উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য আমি নানা সংস্কৃতি ও পরিবেশের মানুষের সঙ্গে মিশেছি। জাপানের পরিবেশ ও জীবনযাত্রা অন্য অনেক দেশের চেয়ে উন্নত। জাপানিদের পেশাদার আচরণ ও মূল্যবোধ অনুকরণীয়। কাজের সঙ্গে তাদের কোনো আপস নেই। যেকোনো ক্ষেত্রে জাপানিরা অনেক ভদ্র। সামাজিক আচরণগুলোকে তারা সম্মান দেয় অনেক বেশি।’

৭. কেউ বৃত্তি ছাড়া পড়তে চাইলে খরচ কেমন?
জাপানের পড়াশোনার জন্য টিউশন ফি একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক রকম। বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ হাজার ডলার থেকে ফি শুরু হয়। বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে ন্যূনতম ৮ হাজার ডলার ফি নেওয়া হয়। জাপানে বৃত্তি ছাড়া পড়ারও সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক খরচের সঙ্গে প্রতি সেমিস্টারে ৫ লাখ ৩২ হাজার ইয়েনের (প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা) মতো ফি যুক্ত হয়।

৮. ঘরে বসে কীভাবে জাপানি ভাষা শিখতে পারি?
জাপানি ভাষা শেখার নানা সুযোগ আছে। ফেরদৌস আরা বলেন, অনলাইনে জাপানি ভাষা শেখার সুযোগ আছে। ইউটিউবসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষা শেখানোর প্ল্যাটফর্ম থেকে যে কেউ জাপানি ভাষা শিখতে পারেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউট থেকেও শেখা যায়। ইংরেজি ভাষার দক্ষতা সনদ আইইএলটিএসের মতো জেএলপিটি (জাপানিজ ল্যাংগুয়েজ প্রফিসিয়েন্সি টেস্ট) দেওয়ার সুযোগ বাংলাদেশে আছে।

৯. পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়?
যায়। জাপানি ভাষা জানলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সহজ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণাগার ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কাজের সুযোগ থাকে। ফেরদৌস আরা জানান, জাপানে কাজের পরিবেশ অনেক পেশাদার। সময়ানুবর্তিতা ও পেশাদার আচরণ সব সময় গুরুত্ব পায়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে সাধারণত ২৮ ঘণ্টার মতো কাজের সুযোগ পান।

১০. জাপানে পড়ালেখা করে সে দেশে চাকরির সুযোগ কেমন?
জাপানে উচ্চশিক্ষা শেষে বর্তমানে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন হ. ইমাম। তিনি জানান, ‘বাংলাদেশের শিক্ষার্থী বা গবেষকদের জাপানে চাকরির নানা সুযোগ আছে। জাপানি ভাষা জানলে সুযোগ বেশি। বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করতে পারেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেন অনেকে। জাপানি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগারে বাংলাদেশিরা যোগ দিচ্ছেন। আবার অনেক শিক্ষার্থী সনি, টয়োটা, হিটাচিসহ নামী প্রতিষ্ঠানেও চাকরি করেন। জাপান থেকে সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী।