যেদিন এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো, ঠিক তার পরদিনই আমাকে কাজে যোগ দিতে হলো। ইনস্যুরেন্স পলিসির খামের ওপর ঠিকানা লেখার কাজটি করে দৈনিক ৮০ টাকা পাই। শুক্র ও শনিবার দুদিন সাপ্তাহিক বন্ধ। বন্ধ মানে আয়ও বন্ধ। ওই দুটি দিন ধানমন্ডিতে একজনের বাসায় গিয়ে কম্পিউটার কম্পোজের কাজ করি।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় বড় সন্তানদের অনেক সময় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমাকেও করতে হলো। কলেজজীবনে পারিবারিক কারণে সংসারের হাল ধরতে হলো।
১৯৯৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর বুঝতে পারলাম, ভালো চাকরি পেতে স্নাতক সম্পন্ন করা দরকার। কিন্তু আমার হাতে এত সময় নেই! পরিবারের সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। ক্লাসে হাজিরা দিতে হয় না, এমন একটি কলেজ খুঁজে পাস কোর্সে ভর্তি হলাম।
সারা বছর চাকরি করি, শুধু পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসি। দুই বছরের মধ্যে পাস কোর্স শেষ করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়কর্মীর চাকরি পেয়ে যাই। তারও ছয় বছর পর প্রাইভেটে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে মাস্টার্স করি। তার পর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু লম্বা শিক্ষা বিরতিসহ নানা কারণে প্রত্যাখ্যান করা হয় আমার আবেদন।
১৮ বছর পর সেই সুযোগ হয়তো এল। ডেটা সায়েন্সের ওপর পর্তুগালের নোভা ইউনিভার্সিটি অব লিসবনের খুব নামডাক। ভর্তির সুযোগ পেলাম এখানেই। বিষয় নির্বাচনে কোনো ছাড় দিতে হয়নি। এত বছরের শিক্ষা বিরতি নিয়ে এখানে কেউ খোঁটাও দেয়নি। বরং কাজের অভিজ্ঞতাকে শক্তি হিসেবে দেখেছে। স্রেফ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ভর্তি পরীক্ষার ভাইভায় যেমন ডিন বললেন, ‘আশা করি তোমার ২৯ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা তোমার শিক্ষাজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
আমার লক্ষ্য মূলত পিএইচডি করার। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে মার্কেটিংয়ে আরও একবার মাস্টার্স করে নিই। আমাদের সময়ের মার্কেটিং আর আজকের বিশ্ববাজারের মার্কেটিংয়ে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেই পার্থক্য বোঝা দরকার।
আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে পর্তুগাল। রাজধানী লিসবনের ছোট্ট সবুজ টিলার ঢালে হেলান দিয়ে আছে এই নোভা আইএমএস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। পয়লা সেপ্টেম্বর নবীনবরণ অনুষ্ঠান শেষে বিভাগের সিটি ট্যুর ছিল। ঘুরতে গিয়ে ভীষণ ভালো লাগল।
সারা জীবন পড়াশোনার জন্য ক্ষুধার্ত ছিলাম। ‘বুড়ো বয়সে’ সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে।