ভেষজ ওষুধে মরবে মশা, গবেষণায় সাফল্যের দাবি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের

প্রায় ২৫০ ধরনের গাছের নির্যাস নিয়ে পরীক্ষা করেছেন গবেষকেরা
ছবি: সংগৃহীত

মশার বংশবিস্তার রোধে যেসব ওষুধ ছিটানো হয়, সেগুলোর অধিকাংশই মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই ক্ষতি না করেও ভেষজ উপাদান ব্যবহার করে কীভাবে কাজটা করা যায়, তাই নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক। তিন বছরের গবেষণা শেষে তাঁরা তৈরি করেছেন এমন এক ভেষজ ওষুধ; তাঁদের দাবি অনুযায়ী যা মশার বিস্তার রোধে কার্যকর, আবার পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর নয়।

গবেষক দলের সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী—খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, সজীব রুদ্র, আরিফ হোসাইন, সনাতনচন্দ্র বর্মন, জয়া দে, সোহাগ হোসেন, শরীফুল ইসলাম, মো. ইসমাইল, খায়রুল আনাম, ইকরামুল হাসান ও সানজানা চৌধুরী। নেতৃত্বে ছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।

যেভাবে গবেষণা হয়েছে

গবেষণার জন্য চট্টগ্রাম নগরীর ৫৭টি স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করা হয়েছিল। লার্ভাগুলো এডিস, অ্যানোফিলিস ও কিউলেক্স মশার। ২৫০টি উদ্ভিদের নির্যাস আলাদা আলাদাভাবে মশার ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে ফলাফল।

আন্তর্জাতিক প্রোটোকল মেনেই গবেষণাটি করা হয়েছে

গবেষণা শেষে গবেষক দল দাবি করছে, সর্পগন্ধা, বনগাঁদা, ফুলকুঁড়ি, নাকফুল, গোলমরিচসহ ১৯টি উদ্ভিদের নির্যাস মশার লার্ভা নিধনে শতভাগ কার্যকর। মরিচা ফুল, তিতবেগুনসহ ৪টি উদ্ভিদের নির্যাস ৯০-৯৯ শতাংশ কার্যকর। এ ছাড়া ৫টি উদ্ভিদ ৮০-৮৯ শতাংশ, ৬টি ৭০-৭৯ শতাংশ, ১০টি ৬০-৬৯ শতাংশ, ১১টি ৫০-৫৯ শতাংশ এবং ৫৫টি উদ্ভিদ ৫০ শতাংশের বেশি লার্ভা নিধন করতে পারে। এ বিষয়ে গবেষক দলের প্রধান মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘প্রতিটি গবেষণার একটি সুনির্দিষ্ট প্রোটোকল থাকে। আন্তর্জাতিক প্রোটোকল মেনে আমরা গবেষণা করেছি। উদ্ভিদের নির্যাস প্রয়োগ করার পর, ৫ মিনিট থেকে শুরু করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মশার লার্ভা তার চলাচল বন্ধ করে নির্যাসের তলানিতে জমা হয়। এই মৃত লার্ভা গণনা করে আমরা ফলাফল তৈরি করেছি। নিশ্চিত হতে প্রতিটি পরীক্ষা তিনবার করা হয়েছে। যেহেতু নির্যাস প্রয়োগে মশার লার্ভা মারা গেছে সুতরাং আমরা নিশ্চিত যে, ভেষজ উপাদানগুলো কাজ করেছে।’

চট্টগ্রাম নগরীর ৫৭টি স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করা হয়েছিল

গবেষণার জন্য গহিন পাহাড়ে

গবেষণার মূল কাজটি পরিচালিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ইথনোবোটানি অ্যান্ড ফার্মাকোগনোসি ল্যাবে। তবে গবেষকেরা বলছেন, উদ্ভিদ সংগ্রহের কাজটি ছিল সবচেয়ে কঠিন। ওমর ফারুক বলেন, ‘মোট ২৫০টি উদ্ভিদ সংগ্রহ করতে হয়েছে। ৯১টি বীরুৎ, ৫৯টি গুল্ম, ৫৭টি কাষ্ঠল, ২৪টি লতা ও ১৯টি ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ। এর মধ্যে কিছু উদ্ভিদ সহজলভ্য ছিল না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গহিন পাহাড় ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে যেতে হয়েছে। কিছু উদ্ভিদ কয়েকবার গিয়ে সংগ্রহ করতে হয়েছে। সঠিক প্রজাতি শনাক্ত করে সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য ছিল।’

গবেষক দলের অন্যতম সদস্য শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘মশার লার্ভা সংগ্রহের সময়ও অনেক বেগ পেতে হয়েছে। যেহেতু এডিস মশা একটা নির্দিষ্ট সময়ে পাওয়া যায়। আবার সব স্থানে পাওয়াও যায় না। এ জন্য মশা সংগ্রহের জন্যও অনেক লোকেশনে ঘুরতে হয়েছে, সঠিক মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।’

মশা রোধে ভেষজ উপাদানের ব্যবহার নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগেও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। সুফলও পাওয়া গেছে। তবে উদ্ভিদের নির্যাসের ঠিক কোন উপাদানটি কার্যকর ভূমিকা রাখছে, সেটা নির্ণয় করে যদি বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিশ্চয়ই আমাদের উপকারে আসবে।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক

প্রয়োজন তহবিল

ভেষজ ওষুধ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আরও গবেষণা প্রয়োজন জানিয়ে ওমর ফারুক বলেন, ‘এই ওষুধ সহজলভ্য করতে আরও কিছু গবেষণা করতে হবে, যার জন্য তহবিল প্রয়োজন। তবে এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার বা অন্য কোনো সংস্থা আমাদের সাহায্য চাইলে আমরা গবেষণার ফলাফল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তাঁদের সামনে তুলে ধরতে পারি। সিটি করপোরেশন যদি সাহায্য চায়, তাদেরও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।’

সার্বিক গবেষণা বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শেখ বখতিয়ার উদ্দীন বলেন, ‘সিটি করপোরেশন যে পদ্ধতিতে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করে মশা নিধন করে, এটা তো দেখা যাচ্ছে কার্যকর নয়। এ জন্য আমরা পরিবেশবান্ধব একটা পদ্ধতি বের করার চেষ্টা করেছিলাম। গতানুগতিকভাবে আমদানি করে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, সেটার চেয়ে এ ওষুধ অনেক বেশি কার্যকর। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এটার মূল্যায়ন যদি পুরোপুরি করা যায়, আমার মনে হয় পরিবেশবান্ধব একটা উপাদান হিসেবে আমরা এটা ব্যবহার করতে পারব, খরচ অনেক কমে যাবে।’

গবেষণাটি এগিয়ে নিতে বিভাগের কী পরিকল্পনা, জানতে চাইলে অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দীন বলেন, ‘যে পরিমাণ তহবিল দরকার, বিভাগ থেকে সেটা এককভাবে জোগানো সম্ভব নয়। কোনো সংস্থা বা সিটি করপোরেশন যদি এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা এটা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে পারি। আমাদের পরিকল্পনা আছে, পরবর্তী ডেঙ্গু মৌসুমে নিজেরাই কিছু প্লট চিহ্নিত করব—যেখানে বেশি বেশি ডেঙ্গু মশা উৎপাদিত হয়; যেগুলোকে আমরা বলি “লার্ভার হটস্পট”। এ রকম কয়েকটি জায়গায় আমাদের শিক্ষার্থী বা স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করে ঘরোয়াভাবে ওষুধটি প্রয়োগ করার ইচ্ছা আছে, যাতে প্রকোপ কিছুটা হলেও কমে। অন্তত কিছুটা হলেও উপকার হয়।’