নারীদের হকিতে যে তিনটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ খেলেছে, তার প্রতিটিতেই অংশ নিয়েছে অর্পিতা পাল। গত মাসে সিঙ্গাপুরে এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপের ৬ ম্যাচে অর্পিতা দিয়েছে ১০ গোল, ৩টিতে হয়েছে সেরা খেলোয়াড়। তার মতো এমন কয়েকজনের কৃতিত্বে ৫ ম্যাচ জিতে প্রথমবারের মতো জুনিয়র নারী এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দিনাজপুরের প্রান্তিক এক পরিবার থেকে উঠে আসা অর্পিতার গল্প শোনাচ্ছেন মাসুদ আলম
দিনাজপুর শহরের জুবিলি উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়ার পর অ্যাথলেট হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে অর্পিতা পাল। হাই জাম্প, জ্যাবলিং আর ১০০ মিটার দৌড়ে স্কুলের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ের জুনিয়র গ্রুপেও নাম লেখায়। জেলা দলের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কারও জিততে থাকে।
অর্পিতা যখন অ্যাথলেটিকসে বুঁদ, তখনই একদিন স্কুলে শুরু হয় মেয়েদের হকি অনুশীলন ক্যাম্প। তাতে নাম লেখায় অর্পিতা। সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়েটা সেই প্রথম হকিস্টিক হাতে নিল। এক মাস চলল অনুশীলন। এরপর দিনাজপুরের বড় মাঠ হিসেবে পরিচিত গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে হকি টুর্নামেন্ট হলো। চ্যাম্পিয়ন হলো অর্পিতাদের স্কুল।
এরপর পরীক্ষা শুরু হওয়ায় স্কুলে অর্পিতার আর হকির চর্চা হলো না। কিন্তু তত দিনে হকির প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেছে। হকি খেললে ভালো করবে, কেন যেন তার এমনটা মনে হচ্ছিল। স্কুলের অনুশীলনে যাঁদের কাছে হাতেখড়ি, তাঁরা তখন বড় মাঠে প্রশিক্ষণ দেন। অর্পিতাও চলে গেল। শুরু হলো হকির সঙ্গে অর্পিতার পথচলা।
২০১৯ সালে ঢাকায় মেয়েদের দল গঠন হবে। তার জন্য মেয়ে হকি খেলোয়াড় দরকার। দিনাজপুর থেকে ক্যাম্পে সুযোগ পেল অর্পিতা। বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম ঢাকায় এসে মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে থাকল কয়েক দিন। এভাবে তৃতীয় দফা ক্যাম্প করার পরই অনূর্ধ্ব-২১ এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপ নারী হকির আসরের জন্য নির্বাচিত হলো।
সিঙ্গাপুরে বসেছিল সেই আসর। আন্তর্জাতিক হকিতে বাংলাদেশের মেয়েদের সেটিই অভিষেক। প্রথম বিদেশে খেলতে গিয়ে প্রতিটি ম্যাচেই সুযোগ পায় অর্পিতা। সেই আসরে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে একটি মাত্র ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। ওই টুর্নামেন্টের চার বছর পর গত আগস্টে আবার আসে আন্তর্জাতিক হকি খেলার সুযোগ। ওমানে ফাইভ আ সাইড বিশ্বকাপ বাছাই হকিতে বাংলাদেশের জার্সিতে গোলের বন্যা বইয়ে দিয়ে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ২০ গোল করে অর্পিতা। ফাইভ আ সাইড হকিতে অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ জেতে তিনটি ম্যাচ।
গত ২৩ জুন সিঙ্গাপুরে শেষ হওয়া এএইচএফ কাপ অনূর্ধ্ব-২১ নারী হকিতে সেই সাফল্যও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর পর নিজেদের দ্বিতীয় এএইচএফ কাপে ছয় ম্যাচের পাঁচটিই জিতেছে বাংলাদেশ, যার তিনটিতে ম্যাচসেরা হয়েছে অর্পিতা। সাত দলের মধ্যে দ্বিতীয় হয়ে অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় জুনিয়র নারী এশিয়া কাপে প্রথমবারের মতো খেলার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ৩১ গোলের সর্বোচ্চ ১০টি মিডফিল্ডার ও দলের ‘নাম্বার টেন’ অর্পিতার, যার ৯টিই পেনাল্টি কর্নারে। বাংলাদেশকে ভরসা জুগিয়েছে অর্পিতার স্টিক।
বিকেএসপির অর্পিতা
২০২০ সালে বিকেএসপিতে শুরু হওয়া মেয়েদের হকির প্রথম ব্যাচের ছাত্রী অর্পিতা। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া অর্পিতা এবার মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেছে। এখন কলেজে ভর্তির পালা। অর্পিতার এই পথচলার পেছনে লুকিয়ে আছে তার মা-বাবার জীবনযুদ্ধ। অমল পাল ও সরস্বতী পালের দুই সন্তানের ছোটজন অর্পিতা। অমল পাল রাজমিস্ত্রি। কাজ থাকলে দিনে ৫৫০-৬০০ টাকা জোটে। সরস্বতী পাল পাঁপড় বানান। পাঁপড় বেচে দিনে কত পান? সরস্বতী পাল বলেন, ‘এক শ পাঁপড় বানালে ২৫ টাকা দেয়। দিনে আড়াই শ-তিন শ বানানো যায়। কখনো কখনো চার শও হয়। মানে এটা হাতের ওপর নির্ভর করে। কোনো দিন ৭৫ টাকা হয়, কোনো দিন ৬৫-৭০। ১০০ টাকার কাজ করতে রাতই লাগি যায়।’
মেয়ে হকিতে ভালো করছে, প্রতিবেশীদের কাছে তাই বাড়তি সম্মান পান সরস্বতী পাল। তাঁর স্বপ্ন ছিল মেয়ে পড়ালেখা করে নার্সিংয়ে ঢুকবে। কিন্তু মেয়ে হলো কিনা খেলোয়াড়। তবে মা এখন খুশি। অর্পিতাকে এসব আপ্লুত করে। পেছনের সময়টা ভোলেন না, ‘এমনও হয়েছে পূজায় নতুন কাপড় পাইনি। আব্বু-আম্মুর কাছে টাকা ছিল না। সে জন্য কিনতে পারিনি।’
অর্পিতার এই পথে ছায়া হয়ে আছেন একজন মতিউর রহমান। দিনাজপুর শহরে মতিউর রহমানের ‘হকি ক্লিনিক’ নামে ক্লাব আছে। নানাভাবে তাঁর সহযোগিতা পেয়েছে অর্পিতা, ‘বাসায় যেসব সংকট ছিল, তা বুঝতে দেননি মতিউর রহমান স্যার। খেলার সরঞ্জামসহ সবকিছু বলতে গেলে উনিই দিতেন। অনেক সহায়তা করেছেন, এখনো করেন।’
সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে খুশিমনে বাড়ি ফিরেছে অর্পিতা। তবে মা-বাবার জন্য কিছু আনতে না পারায় একটু কষ্টও রয়ে গেছে, ‘আমার কাছে সে রকম টাকা তো ছিল না। যেদিন চলে আসব, তার আগে (বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক) সাঈদ স্যার সবাইকে ১০০ ডলার করে দেন। তার আগেই সেখানে একটা জিনিস পছন্দ হয়েছিল। আম্মুর জন্য আনতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আনতে পারিনি বলে কষ্ট লেগেছে।’
এসব কষ্টই দারিদ্র্যকে জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে অর্পিতাকে অনুপ্রাণিত করে।