প্রস্তুত হচ্ছে ভবিষ্যতের সাবিনা–মাসুরারা

প্রত্যন্ত এলাকার এরকম সব মাঠ থেকেই উঠে এসেছে সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন সোনার মেয়েরা। সাতক্ষীরা প্রাণনাথ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতের সাবিনারা
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

কেউ সাইকেলে, কেউ ভ্যানে, কেউ ব্যক্তিগত মোটরযানে, কেউবা আবার আসে হেঁটে। তবে গন্তব্য সবার একটাই—সাতক্ষীরা প্রাণনাথ (পিএন) বহমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠ। এই মাঠেই তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতের সাবিনা–মাসুরারা। বিদ্যালয় চত্বরে বাইরের ওই মাঠে সকাল-বিকেল অনুশীলন করে খুদে ফুটবলাররা। প্রশিক্ষকের কাছ থেকে নেয় ফুটবলের নানা তালিম।

ওই মাঠেই গতকাল সোমবার বিকেলে অনুশীলন করতে এসেছিল পোলস্টার পৌর হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী খুকুমনি খাতুন। বাবার সাইকেল চালিয়ে সে অনুশীলনে এসেছিল। পাঁচআনি সরকারি প্রাথমিক বিদালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া লামিয়া সুলতানার বাবা পেশায় রংমিস্ত্রি। লামিয়া জানায়, প্রতিদিন বিকেলে এখানে সে অনুশীলন করে। খেলার সব সরঞ্জাম বাবাই কিনে দিয়েছেন।

লামিয়া–খুকুমনিদের মতো প্রায় ৫০ জন খুদে ফুটবলারকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন খন্দকার আরিফ হাসান। একসময় খুলনা বিভাগীয় দলে খেলতেন। খেলতেন ঢাকার শান্তিনগর ক্লাবে। খেলা ছেড়ে পরে কুয়েত চলে যান। ২০০০ সালে দেশে ফিরে মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পদক, জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী সদস্য এবং জেলা ফুটবল রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

চলছে অনুশীলন

স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাতক্ষীরায় মেয়েদের ফুটবলে আনার পেছনে আকবর আলীর অবদান সবচেয়ে বেশি। গত ২ জুন হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৮ বছর বয়সেই মারা যান আকবর আলী। তৃণমূলের নিঃস্বার্থ এক কোচ ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুনকে তুলে এনেছিলেন তিনি। ফুটবলে এমন অনেক সাবিনাই গড়ে উঠেছে আকবর আলীর হাতে। কখনো তিনি কোচ, কখনো বাবার ভূমিকায় ছিলেন। নিজের দুই মেয়েকেও ফুটবলার বানিয়েছেন। নিজের গাঁটের পয়সায় ফুটবলার তৈরির কারখানা খুলে বসেছিলেন। সাতক্ষীরায় তৈরি করেছিলেন জ্যোতি ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামের ফুটবল একাডেমি।

প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের ফুটবলে আনতে নানা রকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয় সংগঠকদের

সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের নিজের আগ্রহে ফুটবল মাঠে নিয়ে যেতেন। নিজের বাড়িতে রেখে নিয়মিত অনুশীলন করাতেন। শুধু খেলা নয়, খেলোয়াড়দের পড়াশোনার খরচও জোগাতেন। ফুটবলার সাবিনাই শুধু নয়, দেশের ফুটবলের প্রথম পেশাদার নারী কোচ ও সাবেক ফুটবলার মিরোনা খাতুন, জাতীয় দলের ফুটবলার সুরাইয়া খাতুন, মাসুরা পারভীনদেরও কোচ ছিলেন আকবর আলী।

আকবর আলী চলে যাওয়ার পর হাল ধরেছেন খন্দকার আরিফ হাসান। বঙ্গমাতা ফুটবল একাডেমি এবং স্টুডেন্টস ফুটবল একাডেমি নামে দুটি একাডেমি পরিচালনা করছেন। তিনিও বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। দুই একাডেমি মিলে ৩৫ থেকে ৪০ জন মেয়ে আছে। শহরের সুলতানপুরে নিজের বাসায় আবাসিক ক্যাম্প করছেন। বাসার নিচতলায় মেয়েদের থাকতে দেওয়াসহ খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুই বিনা মূল্যে করছেন। স্থানীয় কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আর্থিক সহায়তা দেন। মাঝে মাঝে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা থেকেও কিছু সহায়তা মেলে।

স্কুল মাঠে অনুশীলন

খন্দকার আরিফ হাসান বলেন, এখনো মেয়েদের খেলায় আনতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বাবাকে, দাদাকে, চাচাকে সবাইকে বোঝাতে হচ্ছে। দুই–তিন মাস ধরে বোঝাতে হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা আছে। মেয়েদের ফুটবল খেলতে দিতে রাজি হতে চায় না। সচ্ছলদের একভাবে বোঝানো হয় আর অসচ্ছলদের একভাবে বোঝাতে হয়। আমার মেয়ে জাতীয় দলে খেলে তাঁর উদাহরণ টানতে হয়।

তিনি জানান, রুমা, রওশানারা, রিক্তা, মুক্তা, সুরাইয়া, সাবিনা, রূপা, মাসুরা—সাতক্ষীরার অনেকেই জাতীয় স্তরে খেলেছে। সাবিনা–মাসুরাদের পরে একট গ্যাপ তৈরি হয়। এখন আবার অনেকে অনুশীলন করছে। কিছুটা হলেও এখন আগ্রহটা বেড়েছে। সাতক্ষীরার অনেক বয়সভিত্তিক দলে খেলছে। অনেকে অনুশীলনে ভালো করছে। বঙ্গমাতায় যারা ভালো করছে, তাদের বুঝিয়ে অনুশীলনে আনছি।

সাতক্ষীরার মেয়ে ফুটবলারদের নিয়ে অনেক আশাবাদী খন্দকার আরিফ হাসান। তিনি বলেন, এখন মানুষের আগ্রহ আগের চেয়ে বেড়েছে, এটা স্বীকার করতেই হচ্ছে। আর এবারের সাফ জয়, এই আগ্রহ অনেক বাড়িয়ে তুলবে বলে আশা রাখি।