কাতার বিশ্বকাপের আগে আরও চারটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আসরে স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক গেমস দিয়ে যাত্রাটা শুরু। এরপর রাশিয়ান ফেডারেশনে শচী ২০১৪ শীতকালীন অলিম্পিক, ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত রিও ২০১৬ অলিম্পিক এবং ২০১৭ সালে তাইওয়ানে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন গেমসেও আমি ছিলাম স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তবে এবারই প্রথম ফিফার কোনো আসরে দায়িত্ব পালন করছি। এ ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আসরগুলোতে সাধারণত দুই ধরনের স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ হয়। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক। কিন্তু কাতারে মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশই অভিবাসী। তাই এবার অভিবাসীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বেশি। এবার স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার।
যত দূর জানি, বাংলাদেশ থেকে আটজন স্বেচ্ছাসেবককে বাছাই করা হয়েছিল। এর বাইরেও আরব আমিরাত থেকে দুই জন প্রবাসী বাংলাদেশি এসেছেন। তবে সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে—পাঁচ শর বেশি কাতারপ্রবাসী বাংলাদেশি এই বিশাল মহাযজ্ঞে লাল–সবুজের পতাকা ওড়াচ্ছেন।
আমরা সবাই ১৫ নভেম্বরের মধ্যেই কাতার পৌঁছে আমাদের ইউনিফর্ম ও পরিচয়পত্র সংগ্রহ করি। এরপর ভেন্যু ট্রেনিং শেষে নেমে পড়ি কাজে। রেজওয়ান, ওয়াসিফসহ আমাদের আরও অনেকের কাজ ছিল আল বায়ত স্টেডিয়ামে, যেখানে এই বিশ্বকাপের উদ্বোধন এবং প্রথম খেলা হয়েছে। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে গ্যালারি—প্রায় সব জায়গায় কাজ ছিল আমাদের। তাই অন্যদের চেয়ে ব্যস্ততাও ছিল একটু বেশি। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়েছে। কখনো কোনো ভিআইপিকে সময় দেওয়া, টিকিট পরীক্ষা করা, কখনো কোনো দর্শককে তাঁর টিকিট অনুযায়ী গ্যালারিতে বসিয়ে দেওয়া, ইত্যাদি।
কলেজের অধ্যাপক হাসানুল স্যারের কাজ পড়েছে আল জাননিউব স্টেডিয়ামে। দুবাইপ্রবাসী সাকিবের কাজ পড়েছে এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে। আরেক বাংলাদেশি তাওহীদ কাজ করেছেন ফিফা ফ্যান জোনে, যেটা দোহার কর্নিশের খুব কাছে। বড় পর্দায় খেলা দেখা, কনসার্ট উপভোগ করাসহ নানা আয়োজন থাকে সেখানে। কাজ যেখানেই হোক, আমরা সবাই চেষ্টা করেছি যেন আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারি। আমরা যে জোনে থাকি, সেখানে অন্যান্য প্রায় ২০টি দেশের স্বেচ্ছাসেবকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম।
একদিকে বিশ্বকাপের মতো আসরে অংশ নেওয়ার রোমাঞ্চ, অন্যদিকে চোখের সামনে বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলার নেইমার, রোনালদো, মেসি, এমবাপ্পেসহ আরও অনেককে কাছ থেকে দেখার সুযোগ—সব এক পাশে রেখে আমাদের লক্ষ্য ছিল যাঁর যাঁর কাজ যেন সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারি। কত যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে! আল বায়ত স্টেডিয়ামে তৃতীয় খেলা ছিল যুক্তরাষ্ট্র বনাম ইংল্যান্ডের। গ্যালারিতে দায়িত্বে ছিলাম আমি। এমন সময় একজন নারী এসে আমার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের একটা পতাকা চান। আমি বলি, আমার কাছে নেই, কিন্তু তিনি চাইলে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। তিনি রাজি হলেন। স্টেডিয়ামের বাইরে গিয়ে পতাকা বিতরণ কেন্দ্র থেকে আমি তাঁর দেশের একটা পতাকা এনে দিলাম। ভীষণ খুশি হয়েছিলেন তিনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং বলেছেন, তাঁর ছেলে যুক্তরাষ্ট্র দলের হয়ে খেলছেন। তিনি পতাকা উড়িয়ে ছেলেকে উৎসাহ দেবেন। এ রকম আরও অনেক ছোট ছোট স্মৃতি জমা হয়েছে বিশ্বকাপে।
রেজওয়ান এবং দুবাইপ্রবাসী করিমের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। বিশ্বকাপে কাজের সুযোগ পেয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছেন কাতারে। অন্যদিকে তাওহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিস্টার বিরতি দিয়েই হাজির হয়ে গেছেন। বেসরকারি চাকরিজীবী অনিক দুই মাসের অবৈতনিক ছুটি নিয়ে এসেছেন। ব্যবসায়ী ওয়াসিফ, দুবাইপ্রবাসী সাকিব শত ব্যাস্ততার মধ্যেও সময় বের করে চলে এসেছেন লাল–সবুজের পতাকা ওড়াতে। হাসানুল স্যার এবং আমি একদিক দিয়ে ভাগ্যবানই বলা যায়। আমরা অফিস থেকে প্রয়োজনীয় ছুটি পেয়েছি।
এ ধরনের আন্তর্জাতিক খেলায় রোমাঞ্চটা যে কী দারুণ, তা নিজ চোখে না দেখলে হয়তো সারা জীবন অজানাই থেকে যেত। বিভিন্ন দলের ভক্তদের আবেগ, উত্তেজনা, উদ্যাপন স্বচক্ষে দেখা সত্যিই অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আজ ফাইনালেও মাঠে থাকব স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। যদিও ব্রাজিলের সমর্থক হিসেবে হেক্সা মিশন সফল হওয়ার দৃশ্যটা সামনে থেকে দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল কাছ থেকে দেখব, এই রোমাঞ্চই বা কম কিসে। অনেক অভিজ্ঞতা তো হলো। দেশে ফিরে চায়ের আড্ডায় কবে, কীভাবে সবাইকে গল্পগুলো বলব, এখন সেই অপেক্ষায় দিন গুনছি।
লেখক: একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা