সবুজ মাঠের একটি অংশে দাঁড়িয়ে আছে কামালপুর যুদ্ধের বীরদের স্মরণে নির্মিত—কামালপুর স্মৃতিসৌধ। পাশে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে এই এলাকাটির অনেক স্থাপনা, স্থান। যেমন মাঠঘেঁষা ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়। প্রাচীরঘেরা এই স্কুলও তো ইতিহাসের এক অংশ। এই বিদ্যালয় থেকেই ৫৯ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে তাঁরা বীরের মতো লড়াই করেছেন। বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন স্কুলের প্রাক্তন তিন ছাত্র বশির আহমেদ, নূর ইসলাম ও মতিউর রহমান। নূর ইসলাম আবার একই সঙ্গে বীর প্রতীক ও বীর বিক্রম।
কামালপুর জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার একটি এলাকা। ভারতের সীমান্তবর্তী। কামালপুর থেকে মাইলখানেক দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ। অনেকেরই হয়তো জানা, মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল মেঘালয় রাজ্যের এই মহেন্দ্রগঞ্জ। তাই কৌশলগত কারণে ১৯৭১ সালে কামালপুর হয়ে উঠেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ বলেই কামালপুর বিওপিতে (বর্ডার আউটপোস্ট বা সীমান্ত ফাঁড়ি) ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। সেই ক্যাম্প দখলে নিতে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর রক্তক্ষয়ী অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এমন এক যুদ্ধেই পা হারান কর্নেল আবু তাহের। শহীদ হন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ শতাধিক বীরযোদ্ধা। একসময় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী। কামালপুরে এমন বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় বীর বিক্রম, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক খেতাব পান মোট ২৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭১ সালের সেই সময়টায় বিভিন্ন সেক্টর ও সাবসেক্টরে ভাগ করা হয়েছে পুরো দেশকে। মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন কোম্পানিতে মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ চলছে। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ধানুয়া কামালপুর কো–অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়েও হাওয়া লাগল মুক্তিযুদ্ধের। বিদ্যালয়টির নবম ও দশম শ্রেণির ছাত্ররা একে একে নাম লেখাতে থাকলেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। ছুটে গেলেন প্রশিক্ষণ নিতে।
তাঁদেরই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার মো. ইয়াকুব। মুঠোফোনে তিনি বললেন, ‘ধানুয়া কামালপুর কো–অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়ে আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। সে সময় দেশের পরিস্থিতি আমরা বুঝে গিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক আমাদের কাছেও পৌঁছে গেছে। গ্রামাঞ্চল হলেও নানা মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের খবর পাচ্ছিলাম। আর ওপাশেই ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ, সেখানে গিয়ে দেখতাম যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। আমাদের বয়সী অনেকেই যুদ্ধে যাচ্ছে, নিজেকে ঘরে রাখা কঠিন হয়ে গেল।’ মুক্তিযুদ্ধে গেলেন খন্দকার মো. ইয়াকুব। শুধু তিনি নন, তাঁর মতো এই স্কুলের আরও অনেক শিক্ষার্থীই নাম লেখালেন।
একসময় খন্দকার মো. ইয়াকুব ধানুয়া কামালপুর কো–অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি স্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনিসহ স্কুলটির কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রাক্তন ছাত্র উদ্যোগী হয়ে একটি তালিকা তৈরি করেছেন। তালিকাটি স্কুল থেকে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের। খন্দকার মো. ইয়াকুব বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন মিলে আমরা একটি তালিকা তৈরি করেছি। সে তালিকা অনুযায়ী, ধানুয়া কামালপুর কো–অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়ের ৫৯ জন ছাত্র তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।’
বিদ্যালয়টির সে সময়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা সম্পর্কেও তিনি ধারণা দিলেন। জানালেন, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী পড়ত ধানুয়া কামালপুর কো–অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়ে। নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীসংখ্যা ছিল ২০০-২৫০ জন। বিদ্যালয়টির বর্তমান প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন বলছিলেন, ‘১৯৬৪ সালে এই স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় আশপাশের এলাকায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। সবাই কামালপুরেই পড়তে আসতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ এক রণাঙ্গন ছিল বলে স্কুলের এত ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।’
যুদ্ধের সময় মতিউর রহমান পড়তেন নবম শ্রেণিতে। বশির আহমেদ ও নূর ইসলাম ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। মতিউর রহমান কামালপুর ছাড়াও বাট্টাজোড়, বশিরউল্লা, মার্দা, দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার আন্ডারচর, কাঠারবিল, জিগাবাড়ী এলাকায় সাহসিকতার সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করতে গিয়ে গুলিতে আহত হন মতিউর।
নূর ইসলামের বীরত্বও অবিস্মরণীয়। নূর ইসলাম ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তাঁর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলোর একটি হয়েছিল তারই নিজ এলাকায়। তাই সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি নূর ইসলামের দায়িত্ব ছিল গাইডের। রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিতেন বলে বেশির ভাগ সময় সমানেই থাকতে হতো। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর ধানুয়ায় এমন এক সম্মুখযুদ্ধে নূর ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। মতিউর রহমান ও নূর ইসলামের চিকিৎসা হয় ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে। এই দুই যোদ্ধার বীরত্বকে সম্মান জানিয়ে বীর প্রতীক খেতাব দেয় বাংলাদেশ সরকার।
পাকিস্তানি ক্যাম্পে কে যাবে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে?
ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের প্রশ্নটি করলেন। কামালপুর সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় গ্রাম ব্রাহ্মণপাড়ায় তখন যৌথ বাহিনীর হাজারো সদস্য উপস্থিত, যাঁরা মৃত্যুকে হাতে নিয়েই যুদ্ধের ময়দানে। কয়েক ঘণ্টা আগেও সম্মুখসমরে বীরত্ব দেখিয়েছেন তাঁরা। তবু এই প্রশ্নে তাঁদের মুখাবয়বে অনিশ্চয়তা।
ব্রিগেডিয়ার ক্লের যখন প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিবাহিনীর এক কিশোর যোদ্ধা বলে উঠলেন, ‘আমি যাব।’ সেই কিশোর যোদ্ধা বশির আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বশির আহমেদ ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।
গেল ১০ ডিসেম্বর মুঠোফোনে বশির আহমেদ জানালেন, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। হরদেব সিং ক্লেরের কাছ থেকে নেওয়া আত্মসমর্পণের চিঠিটি পকেটে নিয়ে কী অসীম সাহসের সঙ্গে তিনি পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়েছিলেন।
বশির আহমেদ বলছিলেন, ‘আমাদের স্কুলের ১০০ গজ দূরেই ক্যাম্পটি। পাকিস্তানি ক্যাম্পের সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আমার হাতে থাকা সাদা পতাকা নাড়ালাম। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’ কারণ, শত্রুপক্ষের ছোড়া একটি গুলিই কিশোর বশির আহমেদের জীবন কেড়ে নিতে পারত। তবে কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনী একসময় ক্যাম্পের ভেতরে তাঁকে ডেকে নেয়। তিনি আত্মসমর্পণের চিঠি পৌঁছে দিলেন বিওপির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের হাতে।
চিঠির বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না পাকিস্তানি বাহিনী। অনেক সময় গড়াল। এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর চারটি যুদ্ধবিমান হামলা শুরু করল। বশির আহমেদকে বাংকারে ঢোকানো হলো। কয়েকজন সৈনিক হতাহত হলো। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে গেল। এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীর আরও একজন এলেন আত্মসমর্পণের চিঠি হাতে। তিনি আনিসুর রহমান। এভাবেই একসময় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শত্রুমুক্ত হয় কামালপুর রণাঙ্গন। আর কিশোর বশির আহমেদ এবং আনিসুর রহমান হয়ে যান কামালপুরে আত্মসমর্পণের নায়ক।
*২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ‘এক স্কুলেই ৫৯ বীর মুক্তিযোদ্ধা’ শিরোনামে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।