এই তিন তরুণের স্টার্টআপ – বাংলার ম্যাথ
এই তিন তরুণের স্টার্টআপ – বাংলার ম্যাথ

গণিত শেখানোর কারবার

গণিত ঘিরেই যে একটা স্টার্টআপ হতে পারে, কেউ কি আগে ভেবেছিল? আমাদের দেশে এমন উদ্যোগ নতুন, ব্যতিক্রমও বটে।

একটু ভিন্ন পথে হেঁটেই ‘বাংলার ম্যাথ’ নামে প্ল্যাটফর্মটা দাঁড় করিয়েছেন তিন তরুণ—আহমেদ শাহরিয়ার, এস এম মাহতাব হোসাইন ও আশরাফুল আল শাকুর। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম আলো গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁদের পরিচয়। জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে একাধিকবার অংশ নেওয়ার সুবাদে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়েছিল আরও। তিনজনেরই যেহেতু ভালো লাগার বিষয় গণিত, তাই ‘১‍+১‍+১=১’ হতে সময় লাগেনি!

তিন বন্ধু দেশের তিন প্রান্তে পড়াশোনা করেছেন। কেউ বেড়ে উঠেছেন খাগড়াছড়িতে। কেউ ঢাকায়, কেউ আবার নোয়াখালীতে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল আলাদা। আহমেদ শাহরিয়ার ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে অ্যারোনটিক্যাল প্রকৌশলে স্নাতক করেছেন। এস এম মাহতাব হোসাইন পড়েছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে, বিষয় কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল। আর আশরাফুল আল শাকুর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশলে ডিগ্রি নিয়েছেন। গণিত অলিম্পিয়াডই তাঁদের এক করেছে।

তিনজনই ২০০৭ সালে প্রথম জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেন। এরপর ২০১৩ সাল থেকে গণিত অলিম্পিয়াডে একাডেমিক সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। এখন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির একাডেমিক কাউন্সেলর শাকুর। শাহরিয়ার ও মাহতাব একাডেমিক মেন্টর হিসেবে যুক্ত আছেন।

সমস্যা ও সমাধান

‘বাংলার ম্যাথ’ নামের উদ্যোগটি চালু হয় ২০২১ সালে। প্রথমে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ ছিল শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন তাঁরা। বুঝিয়ে বললেন আহমেদ শাহরিয়ার, ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গণিত অলিম্পিয়াড প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করি, যেন তাঁরা ক্লাসে আরও ভালোভাবে শিক্ষার্থীদের গণিতের ধারণা দিতে পারেন। যেহেতু আমরা স্টার্টআপ হিসেবে কাজ শুরু করি, তাই কোনো একটা সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা তৈরির পরিকল্পনা আমাদের ছিল। শুরু করার পরে দেখতে পাই, শুধু শিক্ষকদের কর্মশালার মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন করলে হবে না। শিক্ষার্থীদেরও আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাই আমরা গণিতের ঝুলি, আর্ট অব লার্নিং ম্যাথের মতো বিশেষায়িত পদ্ধতি চালু করি। আমরা মূলত দুটি সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করছি। প্রথমত ক্লাসরুমে গণিত শেখার উপকরণের যে ঘাটতি রয়েছে, তা কমিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত শিক্ষার্থীদের গণিতের দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক একটি ব্যবস্থা দাঁড় করানো।’ শিক্ষার্থীরা যেন খেলায় খেলায় গণিত শিখতে পারে, সে জন্য নানা ধরনের পণ্য তৈরি করে বাংলার ম্যাথ। সাজায় নানা কোর্স ও প্রশিক্ষণও।

শিক্ষার্থীরা যেন আনন্দের সঙ্গে গণিত শিখতে পারে, সে জন্য শুধু বই নয়, আরও নানা পণ্য তৈরি করেছেন ৩ তরুণ

হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে

গণিতকে ক্লাসরুমের বাইরে এনে নানা মজার উপায়ে পরিবেশনের চেষ্টা করেন বাংলার ম্যাথের উদ্যোক্তারা। আশরাফুল আল শাকুর বলেন, ‘আমরা শুধু প্রশিক্ষণই দিই না, বিভিন্ন ধরনের বইপত্র প্রকাশ করি। এযাবৎ ছয়টি বই প্রকাশ করেছি। সংখ্যার হিসাবে বলা যায়, এখন পর্যন্ত ২৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে কর্মশালার মাধ্যমে গণিতের প্রশিক্ষণ দিয়েছি, শতাধিক শিক্ষকের গণিত শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করছি। শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং ও রোবোটিকসে আগ্রহী করার জন্য ম্যাথ টু রোবোটিকস নামেও আমরা একটি কর্মশালা করাই। অনেকে বলেন, শহরের স্কুল-কলেজে ভালো গণিত ও বিজ্ঞান শেখানো হয়। আমরা সেই ধারণা ভাঙার চেষ্টা করছি। আমার বন্ধুরা কেউ এসেছে খাগড়াছড়ি থেকে, কেউ এসেছে নোয়াখালী থেকে। আমরা সরাসরি দেখেছি দেশের বিভিন্ন স্থানে কীভাবে গণিত শেখানো হচ্ছে। আমরা স্কুল-কলেজে যেসব সমস্যা দেখেছি, সেই সমস্যা কাটানোর জন্যই বাংলার ম্যাথের মাধ্যমে বিভিন্ন মডিউল তৈরি করছি। আমরা যেমন বান্দরবান-কক্সবাজারের শিক্ষার্থীদের গণিতে আগ্রহী করে তুলছি, তেমনি ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো শহরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়েও কাজ করছি।’

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে

দেশের বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে শাহরিয়ার-মাহতাব-শাকুররা ছোটবেলায় অংশ নিয়েছেন। আর এখন ছোটদের অলিম্পিয়াডের জন্য তৈরি করছেন। মহাখালী ডিওএইচএসে তাঁদের সদর দপ্তরে সকাল-সন্ধ্যা চলে গণিত নিয়ে নানা পরীক্ষণ। মাহতাব বলেন, ‘আমরা বন্ধুরা অনেক বছর ধরে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছি। আমাদের অভিজ্ঞতাকে এখন সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির একাডেমিক কাউন্সিলর হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অলিম্পিয়াডের আদলে আনন্দে গণিত শিখির মতো কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। এখন অলিম্পিয়াড অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। এ বছর আমরা চারটি গণিতের বিশ্ব আয়োজনে অংশ নিয়েছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা পার্পল কমেট ম্যাথ মিট, ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথমেটিকস কম্পিটিশন, ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ ম্যাথ অলিম্পিয়াড আর সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ম্যাথমেটিকস টিম চ্যাম্পিয়নশিপ অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছে। সাফল্যও পেয়েছে।’

আরও নানা সাফল্য আছে এই তরুণ দলের। বাংলার ম্যাথের গণিত শিক্ষার কিটবক্স ‘গণিতের ঝুলি’কে ফিনল্যান্ডের গবেষণা সংস্থা ‘হানড্রেড’ বিশ্বের ১০০টি প্রভাবশালী ও বিস্তারযোগ্য শিক্ষা উদ্ভাবনের তালিকায় স্থান দিয়েছে।