রামদা আর চায়নিজ কুড়াল নিয়ে আমাদের ঘিরে ফেলে তারা

ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে সপরিবার ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি রংপুরে যাচ্ছিলেন তাঁরা। মাঝরাতে টাঙ্গাইলে যানজটে আটকা পড়ে তাঁদের মাইক্রোবাস। মহাসড়কে শত শত গাড়ির মাঝে অতর্কিতে তাঁদের মাইক্রোটাকে ঘিরে ফেলে একদল মুখোশধারী ডাকাত। সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। তিন থেকে চার মিনিটের সেই অভিজ্ঞতার ট্রমা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তাঁরা। এই ঈদে এমন অভিজ্ঞতা যেন আর কারও না হয়, এই আশায় পাঠকের সঙ্গে ঘটনাটা ভাগ করে নিলেন সুজন সুপান্থ

ডাকাত দল মাইক্রোবাসের গ্লাস ভাঙচুর করে টাকা, মুঠোফোনসহ স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়
 ছবি: প্রথম আলো

জীবনের তাগিদে ব্যস্ত রাজধানীতে যাঁরা থাকেন, ঈদে ছুটি পেলেই তাঁরা সবকিছু ফেলে বাড়ির দিকে ছোটেন। দীর্ঘ সড়ক ও অসহনীয় যানজট—কোনো কিছুই তাঁদের দমাতে পারে না। তাঁদের সবাই কি ঈদে আনন্দ করতে যান? মনে হয় না। অনেকেই হয়তো এই শহর থেকে পালাতে যান। কিন্তু সবাই কি আর পালাতে পারেন! যেমন গত ঈদে পালাতে চেয়েও পারিনি আমরা, কোনোরকমে বেঁচে ফিরে সবাইকে নিয়ে বাড়িবন্দী নিরানন্দ ঈদ কাটিয়েছি।

মাইক্রোবাসে বাড়ির উদ্দেশে আমাদের যাত্রা শুরু হয় গত ২০ এপ্রিল সন্ধ্যায়। আমরা পরিবারের আট সদস্য। সঙ্গে ৫ বছর বয়সী কন্যা পারোও আছে। সে যাবে দাদুবাড়ি। গাড়িতে মধ্যমণি হয়ে দাদুবাড়ি নিয়ে আশ্চর্য সব স্বপ্নের কথা সে বলছিল। আমরা তার সহাস্য শ্রোতা। আমাদের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ পেরোনোর কথা। কিন্তু এই পথ ভয়াবহ কঠিন হয়ে উঠেছিল সেই দিন। মনে হচ্ছিল, বহু যুগ ধরে আমরা কেবলই যাচ্ছি, পৌঁছাতে আর পারছি না।

রাত সোয়া একটার দিকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসের সামনে যানজটে আটকা পড়ি আমরা। সামনে শত শত গাড়ি। গরমে অতিষ্ঠ হাজারো মানুষ বাস থেকে নেমে দেখছে যানজট খোলার রেঞ্জ। আর গাড়ির জানালার ভেতর থেকে আমরা দেখছি তাঁদের, দেখছি সামনে দাঁড়ানো হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা। এমন সময় ১০ থেকে ১২ জনের মুখোশধারী একটি দল আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। প্রথমে ভেবেছিলাম, তারা হয়তো যানজট নিরসনকারী স্থানীয় উদ্যোগী তরুণ। পরক্ষণেই ভুলটা ভাঙে তাদের হাতে রামদা ও চায়নিজ কুড়াল দেখে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের ঘিরে ফেলে তারা। মুহূর্তেই গাড়ির গ্লাস ভাঙতে শুরু করে। আমাদের টাকা, মুঠোফোন, স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। ভাবির দুই কান থেকে সোনার দুল ছিঁড়ে নেয় তারা। চারদিকে রক্ত আর ভাঙা টুকরো টুকরো কাচ। পরনের টি–শার্ট খুলে ভাইয়ের মাথা বেঁধে গলায় সজোরে চাপাতির কোপ বসায় একজন। তবে হাত থেকে চাপাতি ছুটে গাড়ির ভেতরে পড়ে যায় বলে কোপটি আর গলায় পড়েনি। আরেকজনের হাতে চাপাতির বাঁট দিয়ে আঘাত করে।

ডাকাতেরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে গাড়ির দুই পাশের চারটি গ্লাস ভেঙে ফেলে

শরীর থেঁতলে যাওয়ার বীভৎসতায় চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলি। পারো জীবনে প্রথমবারের মতো ভয়ে–বাঁচতে চেয়ে মায়ের কোল থেকে ছুটে এসে আঁকড়ে ধরে আমার গলা। তবু সে ছটফটে ময়ূরছানার মতো চঞ্চল। তাকে শার্টের ভেতর লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। এ সময় যানজট ছুটতে শুরু করে। শেষবারের মতো আরেকটি জানালা ভেঙে ফেলে তারা। কাচের সব টুকরো আমার, পারোর আর পারোর মায়ের ওপর পড়ে। শেষমেশ ধারালো কাচের টুকরো দিয়ে একটানে পারোর মায়ের বুক লম্বালম্বি কেটে দেয় তারা।

তিন থেকে চার মিনিট এই বীভৎসতা চালানোর পর যানজট ছুটে যায়। ডাকাত দলের সদস্যরা আস্তে রাস্তা পেরিয়ে যায়। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে অনেকেই দেখেছেন এই দৃশ্য। কেউ এগিয়ে আসেননি। আসেনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাইওয়ে পুলিশও। পরে তারা বলেছে, সড়কের যানজট নিরসন করা ছাড়া আর কোনো কিছুই তাদের দায়িত্বে নেই। রক্ত দেখেছে, তবু জানায়নি হাসপাতালের পথ। বুকের ভেতর থেকে গুঁজে রাখা মুখ বের করে পারো জানতে চেয়েছে, ‘বাবা, তুমি না বলেছ গুড সামারিটান (বিপদে সাহায্যকারী) থাকে। আজ হেল্প করতে এল না কেন?’

বিষয়টি আমার অফিস প্রথম আলোকে জানিয়ে কিছুদূর এগিয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেমে পড়ি। সেখানে সবাই প্রাথমিক চিকিৎসা নিই। ভাবির দুই কানে ১৮টি সেলাই পড়ে। হাসপাতালেই রাত ফুরিয়ে ভোর আসে। সহযোগিতা করতে আসেন প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধি মাসুদ রানা। আসে পুলিশ। তারা লিখিত অভিযোগ পাঠাতে বলেছে, পাঠিয়েছি পরে। দ্রুত ডাকাত দলের সদস্যদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেয় পুলিশ। বাড়ি ফেরার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ফোনে যোগাযোগ করে হারানো জিনিস উদ্ধার করে দোষীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছেন। শুধু বলেছি—মানুষ যেন নির্ভয়ে সড়কে চলাচল করতে পারে, সেই ব্যবস্থাটুকু করতে পারলেই আমাদের দুঃখ ও ব্যথা ঘুচে যাবে।

মাসুদ রানা তাঁর পরিচিতদের নিয়ে ভাঙাচোরা গাড়িটি নিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আবারও শুরু হয় বাড়ির পথে আমাদের যাত্রা। সবাই সবার মুখের দিকে দেখি, আমাদের সব কথা ফুরিয়ে গেছে। কাঁদছি ভীষণ, কিন্তু চোখে পানি আসছে না। কাচজর্জর পা নিয়ে কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পারোর চোখের জল আর শরীরের ক্ষত চেপে ১২ ঘণ্টা ভাঙা কাচের ওপর চুপচাপ বসে থাকা বাবা আমি। স্বপ্নেও পারোর গা থেকে ভাঙা কাচের টুকরো টেনে বের করেছি আমি-আমরা। বাবাকে-মাকে, আর কাউকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না। অন্যের গাড়ি, দাদুবাড়ির চেনা গাড়ি দেখলেই চমকে উঠছে। আমার আয়নাপাগল মেয়ে ভয়ে আয়নায় আর নিজের মুখ দেখতে চায় না। যদি পেছন থেকে কেউ সেই আয়না ভেঙে দেয়, যদি চোখের ভেতরে ঢুকে যায় কাচ, আর পানি না এসে যদি রক্ত আসে চোখে—এই তার ভয় । তার ভয় কাটাতে পারি না। কিচ্ছু পারি না আমি।

মেয়ের ভয়, আমারও ভয় বাড়িয়ে দেয়। একা যখন হাঁটি, মনে হয় নিজের ছায়া লম্বা হয়ে যাচ্ছে। রামদা ও চায়নিজ কুড়াল হাতে আমার ছায়া সেই আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। এমন আশ্চর্য ভয়াবহতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমরা কি আর কখনো মানুষ চিনতে পারব? আর কি ফিরে পাব ঈদে বাড়ি ফেরার আনন্দ?