নক্ষত্রের বাবারা কেন রাস্তায় হারিয়ে যায়

৫ নভেম্বর পাঁচ বছর পূর্ণ করেছে আণীল নক্ষত্র। জন্মদিনে বাবার সঙ্গে বেশ আনন্দ করেছে। কিন্তু সেই আনন্দ দুই দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। ৭ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেছেন তার বাবা। ওই দিন রাতে এক বন্ধুসহ বাইকে ট্রাকের ধাক্কায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ছোট্ট নক্ষত্রের বাবা আরিফুল ইসলাম আরিফ (৪২)। রাজধানীর ইস্কাটনের ইস্টার্ন টাওয়ারের সামনের সড়কে রাত পৌনে ১২টার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে। নিহত অপরজন হলেন আরিফুলের বন্ধু সৌভিক করিম (৪০)।

জীবনসঙ্গী স্মৃতি হয়ে গেছে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ইস্কাটনে আরিফুল ইসলামের বাসায় ১৫ নভেম্বর বিকেলে গিয়ে দেখলাম, নির্বাক হয়ে সোফায় বসে আছেন তাঁর স্ত্রী রেবেকা সুলতানা। ডাইনিং টেবিলে আরিফের বৃদ্ধ বাবা শোকে বাকরুদ্ধ। কিছুক্ষণ পর নিজ ঘরে চলে গেলেন তিনি। রেবেকা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে জানালেন, বাবা আর আগের মতো সবার সঙ্গে কথা বলেন না। বললেন, ‘৭ নভেম্বর রাতে বাসায় ফিরতে দেরি হচ্ছিল দেখে রাত ১২টার দিকে আরিফের মোবাইলে কল করি। ফোন ধরেন হতিরঝিল থানার এসআই। দ্রুত ইস্কাটনের ঘটনাস্থলে যেতে বলেন। গিয়ে দেখি, সব শেষ।’

চোখ মুছতে মুছতে রেবেকা জানান, ‘বাবা হিসেবে আরিফ অসাধারণ। বাসায় থাকলে নিজ হাতে ছেলেকে খাওয়াত, গোসল করাত, রাতে ঘুম পাড়াত। আমি স্কুলের শিক্ষকতা করার কারণে আরিফই ছেলের যত্ন নিত বেশি। বাবা নেই ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছে না নক্ষত্র। ভাবছে বাবা কোথাও গেছে, আবার ফিরে আসবে। আবার আমরা একসঙ্গে ঘুরতে যাব পাহাড়ে বা কোনো নদীর কাছে।’

দেয়ালে সাজানো ছবি দেখিয়ে রেবেকা বলেন, ‘১১ বছর বাইক চালায় আরিফ। কোনো দিন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। বাইকে করে প্রায়ই আমরা তিনজন দূরে ঘুরতে যেতাম। ঘুরতে খুব ভালোবাসত আরিফ।’ মোবাইল বের করে বারবার দেখালেন, কিছুদিন আগে দুর্গাপূজার ছুটিতে তিনজন বেড়াতে গেছেন নারায়ণগঞ্জে। এ মাসেই আবার পাহাড়ে যাওয়ার কথা ছিলে। সবাই হয়তো একসময় ভুলে যাবে। কিন্তু বাবার ভালোবাসা ছাড়া কীভাবে নক্ষত্র বড় হবে! সবচেয়ে বড় ক্ষতি ছেলেটারই হয়ে গেল। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই নক্ষত্র ‘অন্যরকম’ আচরণ করে। সবসময় রেগে থাকে। কারও সঙ্গে কথা বলতে চায় না।

রেবেকা, আরিফ ও ছোট্ট নক্ষত্র

শুধু আরিফুল ইসলাম কিংবা সৌভিক করিমই না, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে গড়ে ৬৮ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনের বাংলাদেশ ফ্যাক্টশিট অনুযায়ী, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়। গড়ে প্রতিদিন ২২০ জন স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনা পৃথিবীতে অষ্টম সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ। ৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে সাড়ে ১৩ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া ৫০ লাখের বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও চিরস্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হয়। বলা আবশ্যক, ৯০ শতাংশ মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোতে হচ্ছে।

প্রতিবছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড ডে অব রিমেম্বারেন্স ফর রোড ট্রাফিক ভিকটিমস (সড়ক দুর্ঘটনার শিকারদের স্মরণ দিবস)’। যারা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের স্মরণে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় এ দিবস। এই বছর ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে সড়ক নিরাপত্তার লক্ষ্যে দিবসটি পালিত হলো। প্রয়োজনীয় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিপজ্জনক রাস্তাগুলোকে নতুন করে ডিজাইন করা, গতিসীমা কমানো, যানবাহনের নকশা পরিবর্তনসহ নানা দাবি উপস্থাপিত হয়েছে।

বাবার মৃত্যুর পর থেকে কারও সঙ্গেই কথা বলতে চায় না পাঁচ বছরের নক্ষত্র

রেবেকা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘সড়কে প্রতিদিন এত মানুষ নিহত ও আহত হয়, আবার সবাই ভুলে যায়। আন্দোলন হচ্ছে নিরাপদ সড়ক নিয়ে। কিন্তু কেউ একবিন্দু সচেতনও হয় না। দুর্ঘটনায় আহত হলে দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে কোনো অ্যাম্বুলেন্সও থাকে না। সেদিন দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে নিলে আরিফ হয়তো বাঁচতেও পারত।’