পেলের কাছে পেলের চিঠি (প্রথম পর্ব)

গত ২৯ ডিসেম্বর মারা গেছেন ফুটবলের রাজা পেলে। ২০১৬ সালে ‘নিজের ছেলেবেলার উদ্দেশে’ নিজেই একটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে প্রকাশিত সেই চিঠির শিরোনাম ছিল ‘লেটার টু মাই ইয়ঙ্গার সেলফ’। তিন পর্বে চিঠির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।

পেলে এখন শুধুই ছবি

প্রিয় এডসন, (অথবা ডিকো, অথবা যে নামেই তোমাকে বাড়ির লোকেরা ডাকে)

মন দিয়ে শোনো

বাড়ির সবাই যখন ত্রেস কোরাসোয়েসে চলে আসবে, তুমি কিন্তু মনে করে তোমার মায়ের মোজা জোড়া সঙ্গে নিয়ে এসো। তোমার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর থাকবে জানি, এরপরও মোজা জোড়া তোমাকে মনে করে আনতেই হবে। যদি ওগুলো আনতে ভুলে যাও, তাহলে তোমার জীবনটা একেবারে অন্য রকম হবে।

তুমি আর তোমার পরিবার বাউরু নামের ছোট একটা শহরে এসে থাকতে শুরু করবে। তোমার বাবার জন্য তোমাদের এই শহরে আসতে হবে। কারণ, বাবা এখানকার বাউরু আতলেতিকো ক্লাবে খেলার সুযোগ পাবে। বাউরুতে তোমাদের বাড়িটা হবে খুবই ছোট। তোমাকে আর তোমার ভাইকে একই বিছানায় ঘুমাতে হবে। সব সময় এটা সুখকর হবে না কিন্তু তোমরা দুজন একসময় খুব ভালো বন্ধু হয়ে যাবে, দেখো।

তোমাদের বাড়ির উঠানে কোনো ঘাস থাকবে না। শুধু থাকবে কাদা আর বালু। এটাই হবে তোমার প্রথম ফুটবল পিচ। জীবনে অনেক বড় বড় মাঠে খেলার সুযোগ তুমি পাবে। কিন্তু ছেলেবেলার জন্য তোমার স্টেডিয়াম হবে তোমার বাড়ির ওই উঠানটাই। তুমি আর তোমার বন্ধুরা লাঠি আর বাঁশ দিয়ে গোলপোস্ট বানিয়ে সেখানেই খেলবে ম্যাচের পর ম্যাচ।

ওই সময় তোমার কাছে ফুটবল কেনার মতো টাকা থাকবে না। এ জন্যই বলেছিলাম, মায়ের মোজা জোড়া মনে করে সঙ্গে রাখতে। কারণ, ওই মোজার ভেতর পুরোনো পত্রিকা ভরে খেলার জন্য তোমাদের ফুটবল বানাতে হবে।

বলটা সব সময় গোল হবে না। তবু চলবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধুরা মিলে ওই বল দিয়েই খেলবে। দলে তোমাকে ডাকা হবে ‘জুতাছাড়া খেলোয়াড়’। কারণ, খেলার জন্য জুতা কেনার মতো অবস্থা তোমার বা তোমার পরিবারের সে সময় থাকবে না। তাই তুমি দ্রুতই কাদামাটিতেই খেলা শিখে যাবে। পানি হবে তোমার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আর কাদা হবে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।

এখনই তোমার চিঠি পড়া বাদ দিয়ে মাকে গিয়ে ‘সরি’ বলা আসা উচিত। কারণ, বছরের পর বছর ধরে মায়ের মোজা দিয়েই তোমাকে ফুটবল বানিয়ে খেলতে হবে।

আহ, তোমার মা! কী দারুণ কঠোর আর শক্তিমান এক নারী। আমি যখন চিঠিটা লিখছি, তত দিনে তার বয়স ৯৯ হয়ে গেছে। এই বয়সে এসেও সে দিব্যি তোমাকে বকা দিয়ে যাবে। যখনই তুমি তাকে দেখতে যাবে, ভুলেও নিজের ইচ্ছেমতো কথা বলতে শুরু কোরো না। তাহলে সে বলবে, ‘এটা আমার বাড়ি। এখানে আমি যেটা বলব, সে বিষয়ে কথা হবে।’ সে সব সময় বাড়ির কর্তা হয়ে থাকবে। তোমার বাবা তো ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে থাকায় সব সময় বাড়ি থেকে দূরে থাকে। তাই মা-ই হবে সেই মানুষটা, যে বাড়ির সব সিদ্ধান্ত নেবে, সঞ্চয় করবে, সবার শখ পূরণ করবে, জামা-জুতা-বই কিনে দেবে, শেখাবে জীবনের সব জরুরি শিক্ষা। একটা শিক্ষার কথা তোমাকে এখনই বলতে চাই।

একদিন তুমি গাছ থেকে আম পেড়ে নিয়ে আসবে। মা জিজ্ঞেস করবে, ‘ডিকো, আম কোথায় পেয়েছ?’ তুমি বলবে, ‘ডোনা মারিয়ার বাড়ি থেকে এনেছি।’

‘তুমি কি এটা তার কাছ থেকে চেয়ে এনেছ?’ মা জানতে চাইবে।

তুমি তখন জানাবে, ‘হ্যাঁ। অবশ্যই বলে এনেছি।’

এটা কিন্তু তখন মিথ্যা বলা হবে। আর মা সেটা মুহূর্তেই ধরে ফেলবে। সে বলবে, ‘চলো তাহলে ডোনা মারিয়ার কাছ থেকে জেনে আসি কথাটা সত্যি কি না।’

একটা সময় তুমি বেশ দুষ্টু ছেলে হয়ে উঠবে। কিন্তু তোমার বয়স যত বাড়বে, এই গল্পটা তোমার মনে হবে আর তুমি বিব্রত হতে থাকবে। মনে রেখো, মা তোমাকে বিব্রত করার জন্য এমনটা বলেনি। মা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছে, শুধু আম চুরি করা এখানে বিষয় নয়, মানুষকে সম্মান করা হলো মূল।

এবার এসো বাবাকে নিয়ে কথা বলি। সে অনেকবার তোমাকে রাস্তায় ফুটবল খেলতে দেখবে। একটা, দুটো, তিনটে, কখনো চারটা গোলও সে তোমাকে করতে দেখবে। তবে কখনোই এ নিয়ে খুশি প্রকাশ করবে না। সব সময়ই বলে যাবে, ‘তোমাকে আরও ভালো করতে হবে।’

সে বলবে, ‘না না না, আমি চাই, তুমি শুধু গোল করাতেই আটকে না থাকো। তোমাকে আরও অনেক কিছু শিখতে হবে, অনেক কিছুর চর্চা করতে হবে। গোল করা ছাড়াও মাঠে আরও অনেক কিছু থাকে, যেগুলোতে তোমাকে দক্ষ হতে হবে।’ এই উপদেশ খুবই মূল্যবান। সব সময় এটা মনে রেখো। এটা মনে রাখলেই জীবনটা তোমার বদলে যাবে। সে একই উপদেশ তোমাকে সান্তোস ফুটবল ক্লাবে খেলার সময়ও দেবে। (সত্যি বলছি, এডসন! একদিন তুমি পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় হবে। শান্ত হও, আরও অনেক কিছু বলার আছে।)

পরের পর্ব পড়ুন আগামীকাল