হঠাৎ অনুভব করলাম, পায়ের নিচের মাটি ভীষণভাবে কাঁপছে

অস্কারের ৯৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো এশীয় নারী সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন। তিনি মিশেল ইয়ো। এভরিথিং এভরিহয়ার অল অ্যাট ওয়ানস ছবিতে অভিনয় করে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এই মালয়েশীয় অভিনেত্রী। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস–এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

মিশেল ইয়ো
ছবি: এএফপি

গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আমার অর্জনগুলো উদ্‌যাপনে শামিল হয়েছেন। প্রথম গোল্ডেন গ্লোব জয় থেকে শুরু করে স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যাওয়ার্ড, ইনডিপেনডেন্ট স্পিরিট অ্যাওয়ার্ড কিংবা সম্প্রতি আমার প্রথম অস্কার জয়—সবই ছিল আলোচনায়। পেশাদার জীবনে এই অসাধারণ মুহূর্তগুলোর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এসবের বাইরে আরও একটি দিকে আমি আলোকপাত করতে অনুরোধ করব, যা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুব নাড়া দেয় এবং ভবিষ্যতের জন্যও যা বড় শঙ্কার কারণ।

আট বছর আগের একটি ঘটনা পৃথিবীর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল।

২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিলের কথা। সঙ্গী জিন টটের সঙ্গে আমি তখন নেপালে বিভিন্ন স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম, পায়ের নিচের মাটি ভীষণভাবে কাঁপছে। যে নিচুতলার ভবনে আমি ছিলাম, তার বাইরেই এক ভয়াবহ ভূমিকম্প পুরো দেশটাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এত ভয় আমি জীবনে কখনো পাইনি। পায়ের নিচের মাটি এত ভয়ংকরভাবে কাঁপছিল যে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। এক রকম হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে এসেছি। যখন সব একটু থিতু হয়েছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। কারণ, কোন ভবনটার দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি আছে, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

মিশেল ইয়ো

শারীরিকভাবে অক্ষত থাকলেও সেদিন আমার মনে গভীর আঁচড় লেগেছিল। সেই ঘটনার প্রভাব আমি আজও বহন করছি। ভূমিকম্পে হোটেলটা সেদিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। হোটেলে ফেরা নিরাপদ নয় বলে আমাদের সোজা বিমানবন্দরে যেতে হয়েছে। উদ্ধার করার আগপর্যন্ত দুই দিন বিমানবন্দরেই থাকতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্লেনটা যখন রানওয়ে ছাড়ল, ওপর থেকে চারদিকে আমি ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার তো যা হোক ফেরার মতো একটা ঘর আছে, হাজারো মানুষের সাজানো সংসার তো মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো—এই ভাবনা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছিল না।

যে মানুষগুলো এমনিতেই খুব সামান্য কিছু আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে, তাঁদের জন্য এ ধরনের দুর্যোগ অপূরণীয় ক্ষতি। ভূমিকম্পের তিন সপ্তাহ পর ত্রাণ নিয়ে যখন নেপালে যাই, তাঁদের দুর্দশা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির শুভেচ্ছাদূত হয়ে এক বছর পর আমি আবারও গিয়েছিলাম।

গত মাসে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের খবর দেখে নেপালের কথা আবার মনে পড়ে গেল। ভূমিকম্প আঘাত হানার আগে থেকেই সিরিয়ার আর্থসামাজিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এখানে দরিদ্র। লাখো মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। অনেকে ঘরহীন। নতুন করে জীবন গড়ার কিংবা পরিবারকে নিরাপদে রাখার কোনো পথ তাঁদের জানা নেই।

আকস্মিক বিপর্যয়ই যে শুধু আমাদের সংকটে ফেলে তা নয়। বরং এর মধ্য দিয়েই সমাজে বিদ্যমান অসমতা ফুটে ওঠে। দুর্যোগের তাৎক্ষণিক ফলাফল হিসেবে পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্য সুবিধা, নিরাপত্তার অসামঞ্জস্য চোখে পড়ছে, যা নারীদের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলে। শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজের সুবাদে আমি দেখেছি, এসব ক্ষেত্রে নারীরাই সবচেয়ে দেরিতে স্কুলে ফেরার, নিরাপদ পানি, টিকা, পরিচয়পত্র ও কাউন্সেলিংয়ের মতো মৌলিক সেবা গ্রহণের সুযোগ পায়। চাকরি ও ঋণের ক্ষেত্রেও নারীরা সুযোগ পায় সবার পরে।

আমরা মহামারি, যুদ্ধ, দুর্যোগে জর্জরিত এক পৃথিবীতে বাস করছি। লড়াই করছি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে। সময়টা অনতিক্রম্য মনে হতেই পারে। কিন্তু এটাও সত্যি যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এক অসাধারণ সময়ে আমরা বাস করছি। এত সব সংকট মোকাবিলায় আমাদের বড় হাতিয়ার হলো তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি। অবশ্য ডিজিটাল দুনিয়াও অসমতায় পরিপূর্ণ। বিশ্বে এখনো ২৭০ কোটি মানুষ ডিজিটাল দুনিয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, যাঁদের একটা বড় অংশই নারী। দুর্যোগের আগে-পরে এবং দুর্যোগের সময়ে নারীদের কণ্ঠস্বর ও নেতৃত্ব যেন সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে, সেটা নিশ্চিত করতে হলে এই ডিজিটাল ভেদাভেদ দূর করা প্রয়োজন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, প্রযুক্তি খাতে তাঁদের শিক্ষিত করা, এসবের পেছনে আমাদের আরও বিনিয়োগ করতে হবে।

আমার বয়স ৬০। সদ্য আমি আমার প্রথম অস্কার জিতেছি। অধ্যবসায়ের মানে আমি জানি। নারীদের কাছে সমাজ কী প্রত্যাশা করে, সে সম্পর্কেও আমি অবগত। সংকটের সময়ে যে নারীরা সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দেন, সেই নায়কদের তুলনায় আমার ভূমিকা কিছুই না। কিন্তু পেশাদার জীবনের এই সুসময়ে যদি একটি কাজ আমি করার সুযোগ পাই, তা হবে সেই সব নারীদের প্রতি আলোকপাত করা, যাঁদের বেশির ভাগ আমাদের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। আমি বলছি, সেসব নারীর কথা, যাঁরা তাঁদের সমাজকে নতুনভাবে গড়ে তুলছেন, সন্তান ও বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখভাল করছেন, মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। যাঁদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা এক হচ্ছি, আলোচনার সময় তাঁরাও যেন সঙ্গে থাকেন; আসুন তা নিশ্চিত করি।

অনুবাদ: মো. সাইফুল্লাহ