বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে কী করবেন?

বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাইলে কিছু নিয়মের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। ছবিটি প্রতীকী
ছবি: অধুনা

বিয়ের পর সুখী দাম্পত্য জীবন সবাই চায়। কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার হিসাব সবার জীবনে সব সময় মেলে না। অনেকের জীবনেই বিয়ের অভিজ্ঞতা সুখকর হয় না, ফলে বিবাহবিচ্ছেদের মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়। বিয়ে যেহেতু একটি আইনি প্রক্রিয়া, তাই কোনো পরিস্থিতিতে যদি বিবাহবিচ্ছেদ করতেই হয়, তাহলে আগে আইনগত দিকগুলো বুঝে নিতে হবে। সঙ্গে বেশ কিছু জরুরি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে বিচ্ছেদের আগেই। সঠিকভাবে আইন অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদ না করলে পরে আবার বিয়ে করতে গেলে নানা রকম আইনগত জটিলতায় পড়তে হয়। এমনকি জেল–জরিমানা হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। তাই সঠিকভাবে আইন মেনে বিচ্ছেদ করতে হবে।

বিবাহবিচ্ছেদ করার নিয়ম

তালাক দেওয়ার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে, তালাক দিতে চাইলে তালাক ঘোষণার পর, অপর পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করছেন, সে এলাকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/সিটি করপোরেশন মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তালাক গ্রহীতাকে ওই নোটিশের অনুলিপি পাঠাতে হবে। নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগে হতে পারে, সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করে অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউসহ (এডি) পাঠালে ভালো হয়।

চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে যে তারিখে নোটিশ পৌঁছাবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হবে। এ নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে। সালিসের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হলেও তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। তবে স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে।

যে পক্ষই তালাক দিক না কেন, যে কাজীর মাধ্যমে নোটিশ সম্পন্ন করা হয়েছে, তালাক কার্যকরের পর তালাকটি সেই কাজী অফিসেই নিবন্ধন করাতে হবে। তালাক নিবন্ধন করা আইনত বাধ্যতামূলক।

স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করা না হয়ে থাকলে তা পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহর আগে পরিশোধ করা হলে তাঁকে ইদ্দতকালীন ভরণপোষণ ছাড়া আর কিছু দিতে হবে না। তবে যেকোনো ক্ষেত্রেই সন্তান সাবালক হওয়া পর্যন্ত পিতাকে তার ভরণপোষণ দিতে হবে।

বিচ্ছেদ ছাড়া আবার বিয়ে করলে

আইন অনুযায়ী এক স্ত্রীর বর্তমানে বিচ্ছেদ না করে আরেকটি বা একাধিক বিয়ে করাকে বহুবিবাহ বলে। এ ক্ষেত্রে স্বামী অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে এক বছর পর্যন্ত জেল ও ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা

অপর দিকে মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, প্রথম স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বা আইনগতভাবে বিচ্ছেদ না করে স্ত্রী যদি আবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে সেই দ্বিতীয় বিয়ে আইনত অবৈধ, অকার্যকর ও বাতিল বলে গণ্য হবে। স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে তাঁকে অবশ্যই আগে প্রথম স্বামীর সঙ্গে যথাযথ আইন মেনে বিবাহবিচ্ছেদ করতে হবে।

বিচ্ছেদের এসব আইনগত বিধান লঙ্ঘন করে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় স্ত্রী যদি অন্য কাউকে বিয়ে করেন, সে ক্ষেত্রে প্রথম স্বামী সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে স্ত্রী ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড পেতে পারেন এবং সেই সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে। স্ত্রী যদি দ্বিতীয় বা পরবর্তী বিয়ে করার সময় যাঁকে বিয়ে করছেন, তাঁর কাছে আগের বিয়ের কথা গোপন করেন, তাহলে সেটি দণ্ডবিধির ৪৯৫ ধারা অনুসারে একটি অপরাধ। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা।

বিবাহসংক্রান্ত অপরাধ আর বিয়ে নিয়ে প্রতারণা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। বিবাহসংক্রান্ত প্রতারণা বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই যেকোনো বিয়ে এবং বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিয়ের উভয় পক্ষকে সচেতন থাকতে হবে। তালাক নিবন্ধন করতে হবে এবং তালাকসংশ্লিষ্ট আইন মেনে চলতে হবে।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী