পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন: আমার স্বামী আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখে না, তাই আমি বাবার বাড়ি চলে এসেছি। আমার কাবিন পাঁচ লাখ টাকা। বিয়ের সময় আমার বাবার বাড়ি থেকে আড়াই ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা যৌতুক দেওয়া হয়েছিল। এখন আমি যদি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিতে চাই, তাহলে আমি কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাব? আমার স্বামী প্রবাসে থাকে, আমি কীভাবে কী করতে পারি জানাবেন। স্বামী প্রবাসে থাকা অবস্থায় কি আমাকে ডিভোর্স দিতে পারবে? মামলা করলে তা সম্ভব হবে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। আপনার প্রশ্নে অনেকগুলো বিষয় স্পষ্ট নয়। আপনি জানিয়েছেন, আপনার স্বামী বিদেশে থাকেন এবং আপনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেন না। তাই আপনি বাবার বাড়িতে চলে এসেছেন। বিয়ের পর মনোমালিন্য কিংবা বনিবনা না হলে অনেক দম্পতি আলাদা বসবাস করেন। তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে দাম্পত্য সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়। সে ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মামলা করতে হবে।
আপনার পরিবার থেকে বিয়ের সোনা ও টাকা যৌতুক হিসেবে দিয়েছিল বলে লিখেছেন। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া—দুটিই বাংলাদেশের আইনে গুরুতর অপরাধ। যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮–এর ৩ ও ৪ ধারায় বলা আছে, যৌতুক দাবি, প্রদান ও গ্রহণ করার দণ্ড হচ্ছে অনধিক ৫ বছর এবং অন্যূন ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। আইনে আরও বলা আছে, যে ব্যক্তি যৌতুক দেওয়া বা গ্রহণ করার ব্যাপারে কোনো ধরনের সাহায্য বা সহায়তা করবেন, তিনিও একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
যৌতুককে কেন্দ্র করে নারী নির্যাতনের চিত্র আমরা যেমন দেখতে পাই, তেমনি আবার যৌতুকসংক্রান্ত মিথ্যা মামলার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। পারিবারিক কলহের জেরে ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে অনেক সময় এ ধরনের মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করেন অনেকে। ফলে নিরপরাধ ব্যক্তি মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যান, যা ব্যাপক হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো আইনানুগ কারণ নেই জেনেও যদি কোনো ব্যক্তি আরেকজনের বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা বা অভিযোগ করেন, তাহলে সেই ব্যক্তি অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এখন আসছি ডিভোর্সের প্রসঙ্গে। আপনার স্বামী চাইলেও পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে তালাক দিতে পারবেন। আপনি চাইলে আপনার স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন। আপনি যদি তালাক চান, তবে কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামটিতে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে কি না, দেখে সরাসরি তালাক দিতে পারেন। যদি ১৮ নম্বর কলামে কোনো ক্ষমতা না দেওয়া থাকে, তাহলে আদালতে যেতে হবে। স্ত্রীর তালাকের ক্ষমতা না থাকলে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নিতে হয়। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
তালাক দেওয়ার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে, তালাক দিতে চাইলে তাঁকে তালাক ঘোষণার পর অন্য পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করে, সে এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান/পৌরসভার মেয়র/সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তালাকগ্রহীতাকে ওই নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে, তখনই/পরবর্তী সময়ে/যথাশিগগির সম্ভব। নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগেও হতে পারে আবার সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করে এডি (অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউ) সহযোগে পাঠালে ভালো হয়।
চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে যে তারিখে নোটিশ পৌঁছাবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হবে। এ নোটিশ পাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করতে হবে এবং সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিসের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। তবে স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে।
যে পক্ষই তালাক দিক না কেন, তা কার্যকরের পর যে কাজির মাধমে নোটিশ সম্পন্ন করা হয়েছে, সে কাজি অফিসে নিবন্ধন করাতে হবে। তালাক নিবন্ধন করা আইনত বাধ্যতামূলক।
এ বিষয়ে অবশ্যই একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করবেন। অনেকের একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় কিংবা আগে তালাকের নোটিশ পাঠান, তাহলে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। স্ত্রী তালাক দিলেও তাঁর মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া যদি স্ত্রীকে আগে কোনো ভরণপোষণ না দেওয়া হয়, বকেয়া ভরণপোষণসহ ইদ্দতকালীন (তালাকের নোটিশ প্রদান থেকে তালাক কার্যকর হওয়া পর্যন্ত সময়) ভরণপোষণ প্রদান করার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এ-সংক্রান্ত কোনো দাবিদাওয়া থাকলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতেও যেতে পারেন।
একটি বিচ্ছেদের কারণে দুই পক্ষই ক্ষতির সম্মুখীন হন। আপনি কী ক্ষতির কারণে ক্ষতিপূরণ চাচ্ছেন এবং কি বিষয়ে মামলা করতে চাইছেন, সেটি আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আপনার স্বামী দাবি করা দেনমোহর বা ভরণপোষণ দিতে অস্বীকার করলে পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।
যেকোনো সম্পর্কে কোনো এক পক্ষ না চাইলে সেটিকে জোর করে বা চাপ প্রয়োগ করে টিকিয়ে রাখা যায় না। আশা করি, আবেগের বশবর্তী হয়ে মিথ্যা বা অপ্রয়োজনীয় মামলায় জড়িয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। বিচ্ছেদ চাইলে শান্তিপূর্ণভাবে সম্মানের সঙ্গে সম্পর্কটি থেকে বেরিয়ে আসুন।
পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA