আমি আলাদা বাসায় থাকি, সন্তানদের বিরক্ত করতে চাই না

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার

মিতি সানজানা
মিতি সানজানা

প্রশ্ন: আমার বয়স ৭২ বছর। প্রায় ১০ বছর আগে আমার স্ত্রী মারা যান। আমার ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। আমি ব্যবসা করতাম। এখন অবসর জীবন যাপন করছি। সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছি। তাদের কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখিনি। আর্থিকভাবে আমি স্বাবলম্বী। সন্তানেরা সবাই বিবাহিত এবং পেশাগত জীবনে সফল। তারা ব্যস্ত। মাসে একবার আমার সঙ্গে দেখা করার সময় পর্যন্ত তাদের হয় না। নাতি–নাতনিদের দেখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু যেহেতু তারা ব্যস্ত থাকে, তাই তাদের বিরক্ত করতে চাই না। আমি আলাদা বাসায় থাকি। আমার দেখাশোনার জন্য ছেলেরা লোক রেখে দিয়েছে। কিন্তু এখন বার্ধক্যে এসে সন্তানদের অনুপস্থিতি একটু বেশি বোধ করি। তাদের সঙ্গ কামনা করি। আমি সন্তানদের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল নই। তাদের প্রতি কোনো অভিযোগও নেই। কিন্তু আমাদের দেশে বৃদ্ধ বয়সে অনেক হতভাগ্য মা–বাবা সন্তানদের নিদারুণ অবহেলার শিকার হয়ে অনেক কষ্টে জীবন যাপন করেন। এর কোনো প্রতিকার আছে কি?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

বনানী, ঢাকা

উত্তর: আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। মা-বাবা বার্ধক্যে উপনীত হলে সন্তানদের কাছ থেকে সেবাযত্নের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভব করেন। তখন মা-বাবার সেবা করা প্রত্যেক সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বৃদ্ধ বয়সে অনেক মা–বাবাই কষ্টে জীবন যাপন করেন। অবহেলার শিকার হয়েও সন্তানদের সুখের কথা ভেবে তাঁরা সবকিছু মেনে নেন। আমাদের দেশে বৃদ্ধ মা–বাবার ভরণপোষণ দেওয়া একটি আইনগত বাধ্যবাধকতা। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ‘পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩’ নামক একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটি সম্পর্কে অনেকেরই কোনো ধারণা নেই।

মা–বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করা এবং তাঁদের সঙ্গে সন্তানের বসবাস বাধ্যতামূলক করার বিধান রেখে সরকার ২০১৩ সালে এই আইন করে। মা–বাবার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তাঁর মা-বাবার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে এবং একাধিক সন্তান থাকলে প্রত্যেককে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতে ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে।

আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো সন্তান তাঁর মা–বাবাকে অথবা উভয়কে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধাশ্রম কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। সন্তানেরা তাদের মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। শুধু তা–ই নয়, মা–বাবাকে নিয়মিত সঙ্গ প্রদান করার কথাও আইনে বলা আছে। কোনো সন্তানের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে বা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়, তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবে। তাদেরও এই আইনের অধীন শাস্তির আওতায় আনা যাবে।

মা–বাবার ভরণপোষণ আইনের ৩ (৭) ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সঙ্গে বসবাস না করে আলাদাভাবে বসবাস করলে, উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তার প্রতিদিনের আয়-রোজগার, মাসিক আয় বা বার্ষিক আয় থেকে যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, বা ক্ষেত্রমতে উভয়কে নিয়মিত প্রদান করবে। অথবা মাসিক আয়ের কমপক্ষে দশ ভাগ পিতা-মাতার ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করবে।’

কোনো ব্যক্তি মা–বাবার ভরণপোষণ আইন অমান্য করলে প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচার করা হবে। কোনো আদালত এ আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ বাবা বা মায়ের লিখিত অভিযোগ ছাড়া আমলে নেবে না। আইনে আপস-নিষ্পত্তির ধারাও সংযুক্ত করা হয়েছে।

মা–বাবার ভরণপোষণ আইন ২০১৩-এর ৫ (১) ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো প্রবীণ তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আনেন এবং সে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে তাদের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে এই আইনের ব্যবহার আমাদের দেশে এখনো খুবই কম।

আপনার সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি। আপনার নিজের হয়তো কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, তবে আশা করি আপনার এই প্রশ্নের মাধ্যমে অন্যরা উপকৃত হবেন।

পাঠকের প্রশ্ন পাঠাবেন যেভাবে

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা

প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫।

(খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA