ডেস্কের এক কোনায় পড়ে আছে অরণ্যের দিনরাত্রি। ‘পড়ব, পড়ব’ করেও পড়া হচ্ছে না। কারণ, সময় করে উঠতে পারছি না। ভাবলাম, সপ্তাহান্তের ছুটিতেই এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসব, সঙ্গে থাকবে অরণ্যে ছুটে যাওয়া একদল তরুণের গল্প!
প্রিয় বান্ধবী থাকে শহরের অন্য প্রান্তে। জ্যামের সমুদ্র পার করে সপ্তাহের মাঝখানে তার কাছে যাওয়ার ফুরসত মেলে না। মনে মনে পরিকল্পনা করে ফেললাম, এই উইকেন্ডেই একবার বান্ধবীর কাছে চলে যাব, আবার জমে উঠবে পুরোনো আড্ডা।
আলমারিটা অগোছালো হয়ে আছে বহুদিন। সাদা শার্টটা যে এলোমেলো কাপড়ের কোন স্তূপটায় লুকিয়েছে, বুঝতেই পারছি না! কখন গোছাব? ছুটির দিনে!
বহুদিন ছবি আঁকা হয় না, রংতুলিতে ধুলোর স্তর পড়ে যাচ্ছে, কবে আঁকব? উইকেন্ডে!
লাউপাতায় চিংড়ির রেসিপিটাও করা হচ্ছে না বহুদিন, কবে করব? শুক্রবারে!
একটু মনভরে ঘুমোতে চাই! কিন্তু কবে? সেই ছুটির দিনেই তো!
এভাবেই একের পর এক শখের কাজ, সময়সাপেক্ষ কাজ, তুলে রাখা পরিকল্পনারা ছুটির দিনে এসে ভিড় করে। সপ্তাহের অন্যান্য দিন আমাদের বড্ড তাড়াহুড়া, বড় বেশি ব্যস্ততা। কাজের চাপে, রুটিনের ঘোরপ্যাঁচে আমরা অনেকেই বন্দী এক জীবনযাপন করি। ছুটির দিন তাই আমাদের নাগরিক জীবনে একচিলতে তেপান্তর! সেই তেপান্তরেও দায়িত্বের বোঝা ঘাড় থেকে নামানো হয়ে ওঠে না। হয়তো ঘর পরিষ্কার করার ঝক্কিতে আর প্রিয় বই নিয়ে বসার সময় মেলে না! নয়তো বই নিয়ে বসায় বান্ধবীর বাড়িতে আর যাওয়া হয় না! বান্ধবীর বাড়িতে গেলে নিজের পরিবারের জন্য সেই যে লাউপাতায় চিংড়ি রাঁধতে চেয়েছিলেন, তা হয়তো আর করার সময় মেলে না। আর যদি সকালে ঘর পরিষ্কার করে, দুপুরে লাউপাতা চিংড়ি রেঁধে-বেড়ে-খেয়ে, বিকেলে বই পড়ে, সন্ধ্যায় বান্ধবীর বাসায় গিয়ে পৌঁছাতেও পারেন—দেখবেন দিন শেষে ক্লান্তিতে অবশ হয়ে আসছে স্নায়ু। সবকিছু সেই এক ছুটির দিনে করতে গিয়ে নিজের শরীর ও মনকেই আর স্বস্তি দেওয়া হয়নি! কাঙ্ক্ষিত ছুটির দিনেও ব্যস্ততাই গ্রাস করেছে আপনাকে! আমার মতো ঘরে ফিরে কেবল বলতে ইচ্ছে করবে, ছুটি অ্যাত্ত তাড়াতাড়ি কেন শেষ হয়?
তবে একটু পরিকল্পনা, একটু প্রস্তুতি সত্যিই আপনার ছুটির দিনকে করে তুলতে পারে ‘আপনার’ মনের মতো!
হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে একটু সময়, একটা ছুটির দিন পেলে আমাদের অনেক কিছুই করতে ইচ্ছা করে। আর সবকিছু একসঙ্গে করতে গেলেই বিশ্রাম আর স্বস্তির আস্বাদ পাওয়া হয় না। তাই পরিকল্পনা করে ফেলুন আগেই।
মাসে কারও ছুটি চার দিন, কারও হয়তো আট দিন। ব্যক্তিগত ক্যালেন্ডারে লিখে রাখুন কোন ছুটির দিনটায় ঘর পরিষ্কার করবেন, কোন উইকেন্ডে বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত, আর কোন ছুটির দিনে আপনি শুধু নিজেকেই সময় দেবেন! যাঁরা আরও বিস্তারিত পরিকল্পনা করতে ভালোবাসেন, তাঁরা ঠিক করে ফেলতে পারেন ছুটির দিনের বিভিন্ন সময়ে আপনি কী কী করবেন। হয়তো এ সপ্তাহের ছুটিতে আপনি সকালবেলায় সঙ্গীর সঙ্গে চলে গেলেন ব্রেকফাস্ট ডেটে, পরের ছুটিতে আরেকটু বেশি ঘুমিয়ে নেওয়াই হতে পারে আপনাদের ছুটি উদ্যাপনের রীতি! তবে এতসব পরিকল্পনা যেন আপনাকে মানসিক চাপে না ফেলে সেদিকটাও খেয়াল রাখুন। আগেই পরিকল্পনা করার অভ্যাস থাকলে আপনার সঙ্গীর জন্যও বিষয়টি সহজ হয়ে ওঠে। যেমন বান্ধবীকে আগেই জানিয়ে রাখতে পারবেন কবে তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। আবার পূর্বপ্রস্তুতির বিষয়টিতেও জটিলতা থাকে না। আপনার যদি জানা থাকে কোন ছুটিতে আপনি শহরের বাইরে যেতে চান, তবে আগেই টিকিট ও হোটেলের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রস্তুত হতে পারবেন আপনি।
পুরো সপ্তাহের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য ছুটির দিন এক দারুণ সুযোগ! আমরা অনেকেই হয়তো রেস্তোরাঁয় বসে সময় কাটানোর এই শহুরে প্রবণতায় হাঁপিয়ে উঠেছি। কী করলে এই একঘেয়েমি কাটবে, সে উপায় খুঁজে নিন। নাগরিক ব্যস্ততায় যদি ক্লান্ত বোধ করেন, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়ুন লং ড্রাইভে। নিজেকে সময় দেওয়া হচ্ছে না যদি মনে হয়, তবে একটা বিকেল নিজেকেই সঙ্গ দিন। পুরোনো ছবির অ্যালবাম খুঁজে বের করুন, অথবা পপকর্নের প্যাকেট নিয়ে বসে পড়ুন সিনেমা দেখতে। বই পড়তে ভালোবাসলে আপনার আশ্রয় হতে পারে প্রথমা বুক কাফে, বাতিঘর, বেঙ্গল বই, বুকওয়ার্মের মতো বুক ক্যাফেগুলো। আরও ভিন্ন কিছু করতে চাইলে খোঁজ নিন শহরজুড়ে কী হচ্ছে এই সপ্তাহান্তে? যেতে পারেন মহিলা সমিতি বা শিল্পকলা একাডেমিতে, দেখতে পারেন নাটক বা প্রদর্শনী। ছোট ছোট নানা ইভেন্টও হয় শহরজুড়ে। গ্যেটে ইনস্টিটিউট, ইএমকে সেন্টারে কোনো কোনো ছুটির দিনে দেখানো হয় নতুন-পুরোনো সিনেমা। ক্লে স্টেশন বা কল্পকারের মতো কিছু জায়গাও গড়ে উঠেছে এখন ঢাকায়। একাই বা সঙ্গীর সঙ্গে এ জায়গাগুলোয় ক্লে দিয়ে তৈরি করতে পারেন নানা কিছু অথবা থ্রিডি পেনে তৈরি করতে পারেন সুন্দর সময়ের ‘মেমেন্টো’।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন আমাদের জীবনে বড় প্রভাব রাখে। হয়তো অন্য কাউকে দেখছেন বইয়ের দোকানে গিয়ে সুন্দর ছবি পোস্ট করতে, অমনি আপনার মনে হলো ‘আমি কেন যাচ্ছি না!’ এমন সব আক্ষেপ থেকে বা নিছক ট্রেন্ডের জোয়ারে ভেসে ছুটির দিন কাটানোর চেয়ে আপনার ভালো লাগার কিছু করাই শ্রেয়। অন্য কারও ছবি দেখে বা কথা শুনে অনেক কিছুই করার ইচ্ছা হতে পারে, তবে তার সঙ্গে আপনার ভালো লাগার সংযোগ কতটুকু, সেটি ভেবে দেখতে ভুলবেন না। ছুটির দিনে ‘অনুরোধের ঢেঁকি গেলা’র বিষয়ে খানিকটা সতর্ক থাকা ভালো। পুরো সপ্তাহের মধ্যে এই একটি বা দুটি দিনই আপনার দিন। তাই স্রেফ সামাজিকতার বেড়াজালে পড়ে এমন কিছু না করাই ভালো, যা আপনাকে আরও ক্লান্ত করে, শ্রান্ত করে, মানসিক চাপে ফেলে। আরও মনে রাখুন, ছুটির দিনে ভালো সময় কাটানোর জন্য যে সব সময় আপনাকে খুব ভিন্ন কিছু, খুব বিলাসী কিছু, খুব ট্রেন্ডি কিছু করতে হবে, তা কিন্তু নয়। খুব সাদামাটা কোনো কিছু, ছাদে বসে সঙ্গীর সঙ্গে কাটানো একটা বিকেল অথবা শৈশবের গলিতে দুই পা হেঁটে আসাও আপনাকে দিতে পারে নতুন উদ্যম।
আজ বুধবার। ছুটির দিনটি আসতে আরও পাক্কা দুটো দিন বাকি! তবু আমি কিন্তু ভাবতে শুরু করেছি কী করলে এই ছুটিটা আমার ভালো কাটবে। খোঁজ নিতে শুরু করেছি শহরের কোন প্রান্তে এই উইকেন্ডে জমে উঠবে কনসার্ট, সিনেমার আসর বা থিয়েটার। ছোট্ট এক প্রদর্শনীরও খোঁজ দিয়েছে এক বন্ধু! হয়তো শেষমেশ অল্প কিছু ভালো লাগার মুহূর্ত, প্রিয় কিছু মুখের সান্নিধ্যেই কেটে যাবে আটচল্লিশ ঘণ্টার এই ছুটি। তবু ভাবতেও ভালো লাগে আর দুই দিন পরই মিলবে বিশ্রাম, ফুরসত, মুক্তি!