সন্তানের বেড়ে ওঠা থেকে তাদের ভবিষ্যতের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে মা-বাবার ওপর
সন্তানের বেড়ে ওঠা থেকে তাদের ভবিষ্যতের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে মা-বাবার ওপর

সফল সন্তানদের মা-বাবার মধ্যে যে ৭ গুণ থাকে

সন্তানের বেড়ে ওঠা থেকে তাদের ভবিষ্যতের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে মা-বাবার ওপর। আপনি আপনার সন্তানকে কীভাবে বড় করছেন, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সাফল্যের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই, ব্যক্তিভেদে সাফল্য হতে পারে বিভিন্ন রকম। কেউ চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হয়ে সফল, আবার কেউ খেলাধুলা করে। তবে এমন কিছু গুণ আছে, যা সব সফল সন্তানের মা-বাবার মধ্যে থাকেই। তেমনই ৭টি ‘কমন’ বিষয় সম্পর্কে জানা যাক—

১. শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা

কোনো শিশুই জ্ঞানী হয়ে জন্মায় না; বরং জন্মের পর ধীরে ধীরে তারা জ্ঞানী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ শৈশবে সব শিশুর মেধাই কমবেশি সমান থাকে। তারপর কে কতটা জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান হবে, তা নির্ভর করে পরিবেশ ও পরিবারের ওপর। আর এ ক্ষেত্রে পরিবারের উচিত শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা। সফল সন্তানের মা-বাবা সব সময় তাঁদের সন্তানদের বলেন, ‘তুমি অন্যদের চেয়ে স্পেশাল’, ‘তুমি যা হতে চাও, তা-ই হতে পারবে’। এতে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়, জীবনে সফল হওয়ার জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু মনে করে পড়াশোনার ফলাফলের ওপর তাদের কোনো হাত নেই, বরং তাদের মেধা কম, তারা আসলেই ফলাফল খারাপ করে। কিন্তু যারা বিশ্বাস করে, সে চাইলেই ভালো করতে পারে, তাদের ফল সত্যিই ভালো হয়। সুতরাং শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা মা-বাবার অন্যতম দায়িত্ব।

২. শিশুদের দিয়ে ছোটখাটো কাজ করানো

ছেলেমেয়ে উভয়কে কিছু কিছু কাজ শেখানো উচিত একদম শৈশবে। তাহলে তারা বড় হয়ে কোনো কাজকে ছোট করে দেখবে না। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক জুলি লিথকোট-হাইমস এ বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে, আপনার সন্তান যদি খাবার খেয়ে নিজের প্লেট পরিষ্কার করতে না পারে, তার মানে তার হয়ে কাজটা নিশ্চয়ই কেউ করে দিচ্ছে। এতে সে কেবল কাজ থেকে মুক্তি পাচ্ছে, তা নয়; বরং শিখতেও পারছে না। জুলির মতে, শৈশবে এ ধরনের কাজে এগিয়ে এলে বড় হয়ে ওই ব্যক্তিরা সহকর্মীদের কাজের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখায় এবং কোনো কাজ করতেই দ্বিধাবোধ করে না। নিজের কাপড় ধোয়া, বিছানা পরিষ্কার করা, পড়ার টেবিল গুছিয়ে রাখার মতো টুকিটাকি কাজগুলো শিশুরা করলে তারা বুঝতে পারবে, এটাও জীবনের অংশ। 

৩. সামাজিক দক্ষতা শেখানো

যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের সামাজিক দক্ষতার ব্যাপারে ২০ বছর ধরে একটা গবেষণা চালানো হয়েছে। দেশটির পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি ও ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা কিন্ডারগার্টেন থেকে ২৫ বছর বয়সী ৭০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে এ গবেষণা চালিয়েছেন। ২০ বছরের গবেষণা শেষে দেখা গেছে, যেসব শিশু সমবয়সীদের সহযোগিতা করে, তাদের অনুভূতি বুঝতে পারে কিংবা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাদের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সম্ভাবনা বেশি। এ ধরনের শিশুরা বড় হয়ে ২৫ বছর বয়সেই পূর্ণকালীন চাকরি করতে পারে এবং জীবনে বেশি সফল হয়।

৪. শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা

শিশুরা স্কুলে ভর্তি হলে ধীরে ধীরে তাদের জীবনে বন্ধু আসে। জীবনে বন্ধুর গুরুত্ব অনেক। তবে বন্ধু বাছাইয়ে সচেতন হওয়াও জরুরি। এই বয়সে মা-বাবা যদি সন্তানদের বন্ধু হতে পারেন, তাহলে শিশুর বিফল হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। ২০১৪ সালে ২৪৩টি শিশুর ওপর একটা সমীক্ষা করা হয়। সেখানে দেখা গেছে, দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম নিয়েও যেসব শিশুর সঙ্গে মা-বাবার ভালো বন্ধুর মতো সম্পর্ক, তারা উচ্চশিক্ষায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক ফলও তাদের ভালো। আসলে মাঝেমধ্যে যেকোনো মানুষই বিপদে পড়তে পারে। তখন মা-বাবাকে পাশে পাওয়া গেলে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়। তবে এ জন্য মা-বাবাকে হতে হবে সন্তানদের প্রথম বন্ধু।

৫. শিশুকে কৌতূহলী করে তোলা

স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা কৌতূহলী, অনেক প্রশ্ন তাদের মনে। বড় হতে হতে মনের মধ্যে অনেক জিজ্ঞাসা জেগে ওঠে। এটা কী, ওটা কেন হয়, কীভাবে হয়? কিন্তু এতে বিরক্ত না হয়ে মা-বাবার উচিত সম্ভাব্য উত্তর দেওয়া। শিশুর মধ্যে জানার আগ্রহ গড়ে তুলতে হবে। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অনেক সময় শিশুর প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে প্রথমে তাদের মত জানতে চাওয়া উচিত। যেমন আপনার সন্তান জানতে চাইল, আকাশ কেন নীল? এ প্রশ্নের উত্তর আপনি সরাসরি না দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করুন, সে কী মনে করছে। এতে দুটি কাজ হবে। এক. নিজে উত্তর ভাবার চেষ্টা করবে, দুই. শিশুর মনে হবে, আপনি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, এতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

৬. শৃঙ্খলার মধ্যে রাখা

শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শৃঙ্খলা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। শৈশবে তাদের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে, বড় হলে আর সম্ভব হয় না। ঘুম থেকে কখন উঠতে হবে, কোন সময়ের খাবার কখন খাবে, বিকেলে মাঠে খেলতে গেলে কখন ফিরে আসবে—এ ধরনের শৃঙ্খলা বা সময় আদতে বড়দেরই ঠিক করে দিতে হবে। শৈশবে এই শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হলে জীবনের বাকিটা সময় জীবনযাপন হয়ে ওঠে সহজ।

৭. লেখাপড়ার বাইরের কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া

সফল সন্তানের মা-বাবার সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের শুধু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। প্রতিটি শিশুর মধ্যেই কোনো না কোনো প্রতিভা বা গুণ থাকে। কেউ ভালো গায়, কেউ ভালো ফুটবল খেলে, কেউ গণিতে খুব ভালো। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাশাপাশি তাকে তার পছন্দের বিষয় শিখতে সাহায্য করুন। দেশে এখন অনেক অলিম্পিয়াড হয়। সেসবে তাদের অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিন। সবাই প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায় না, কিন্তু অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে, যা অমূল্য। শৈশবে শিশুদের গণিতের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেন। গাণিতিক দক্ষতায় যারা এগিয়ে থাকে, ভবিষ্যতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা তাদের বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইংল্যান্ডের প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে ২০০৭ সালে একটি গবেষণা করা হয়। সেখানে দেখা গেছে, যাদের গাণিতিক দক্ষতা যত ভালো, তারা তত বেশি সমস্যা সমাধান করে সফলতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষক গ্রেগ ডানকান বলেন, ‘একটি শিশুর ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল হবে, তা তার গাণিতিক দক্ষতা থেকে পূর্বাভাস পাওয়া যায়।’

সূত্র: সিএনবিসি, মিডিয়াম, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও কোর্ট হাউস একাডেমি