‘সন্দেহের’ শক্তিতে বিশ্বাস রাখুন

লিডিয়া ভিয়া কামারফ আণবিক ও সেলুলার জীববিজ্ঞানী। বিজ্ঞানীদের যে দলটি ইনসুলিন আবিষ্কারে কাজ করেছিলেন, সেই দলের তিনি অন্যতম সদস্য। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে যে কজন নারী বিজ্ঞানীর পরিচয় হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল, তাঁদেরও অন্যতম কামারফ। গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সিটি অব হোপ গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের (আইরেল অ্যান্ড মানেলা গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের) ২৪তম বার্ষিক অনুষ্ঠানে গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন লিডিয়া ভিয়া কামারফ। সেই ভাষণেরই নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো—

লিডিয়া ভিয়া কামারফ
ছবি: ফেসবুক থেকে

আজ এখানে আসতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। প্রথমেই স্নাতক সম্পন্ন করা সবাইকে অভিনন্দন। সেই সঙ্গে অভিনন্দন আপনাদের পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও আপনাদের শিক্ষকদের, যাঁরা কি না আপনাদের সঙ্গে এ পর্যন্ত পথ এসেছেন। আজ আপনারা বিজ্ঞানী হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেন।

আমরা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরিবেশ থেকে আসি। আমাদের মধ্যে কেউ অন্তর্মুখী। আবার অনেকেই আছেন, যাঁরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে কৌতূহলী। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে আমরা এখানে এসেছি। এই বৈচিত্র্যময় পরিবেশ আমাদের গড়ে তুলেছে। আর এই পরিবেশই আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে, কোন ধরনের প্রশ্ন আমরা সামনে আনব আর কীভাবেই–বা এই প্রশ্নগুলো আমরা উত্থাপন করব।

সব বিষয়েই আমরা কৌতূহলী। যদিও এই বিশ্ব সম্পর্কে, আমাদের পরিপার্শ্ব সম্পর্কে এবং নিজেদের সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। তবে আমরা উত্তর খুঁজি এক পদ্ধতি অনুসরণ করে। মাঝেমধ্যে আমরা উত্তর খুঁজে পাই। তথ্য–উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে আমরা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। তথ্য–উপাত্ত এমন জিনিস, যা পরীক্ষা করা যায়, যাচাই করা যায়।

আমরা বিশ্বাস করি, যেসব বস্তু বা নথি পাওয়া যায়, সেগুলো পুনরায় নির্মাণ করা যায়।আমরা ‘সন্দেহর’ শক্তিতে বিশ্বাস রাখি। এই ‘সন্দেহর’ শক্তি নিয়ে কখনো সন্দেহ পোষণ করবেন না। কারণ, এই সন্দেহ আপনাকে একটি ভালো জায়গায় নিয়ে যাবে।

আরেকটি বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত। আমরা ন্যাচারাল সায়েন্টিস্ট। অনেক সময় হয় কি, ন্যাচারাল সায়েন্সের বাইরে থেকে আসা জ্ঞানকে আমরা উপেক্ষা করি। কিন্তু আমি আপনাদের বলতে চাই, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা যদি ন্যাচারাল সায়েন্সের বাইরের জ্ঞান, যেমন সমাজবিজ্ঞান, সম্পর্কে না জানি না বুঝি, তবে প্রত্যাশা অনুসারে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না।

বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিচক্ষণ মানুষদের যুক্ত করে আমাদের কাজ করতে হবে। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত, এমন মানুষদের নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। যেমন নারী, বিভিন্ন বর্ণের মানুষ—এমন সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। এরপর কৌতূহল আপনাকে একটি আকর্ষণীয় পথের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

একটি বিষয় এখানে মনে রাখা ভালো, নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া খুব সহজ। কিন্তু এমন কিছু পাওয়া কঠিন, একই সঙ্গে যা গুরুত্বপূর্ণ। একটি গুরুত্বহীন সমস্যা সমাধান করা কিন্তু একটি সহজ সমস্যা সমাধানের চেয়ে কম কঠিন নয়। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুঁজে বের করাটা জরুরি।

গবেষণায় সফল হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এমন একটি সমস্যা খুঁজে বের করা, যেটা সমাধান করার মতো উপাদান আছে। আর এটাই ছিল বিজ্ঞানী আর্থার রিগসের (ইনসুলিন গবেষণা দলের নেতা) অন্যতম লক্ষ্য। কী করতে হবে, কখন করতে হবে, তিনি জানতেন। তিনি যেটা করতেন, সেটা কেন করছেন, উপলব্ধি করতে পারতেন।

কয়েক বছর ধরেই বিজ্ঞানের ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাস কমছে। সেই অবস্থা এখনো চলমান। বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাসের যে ঘাটতি, করোনা মহামারির সময় সেটা আরও বেড়েছে। যদিও এই মহামারির সময় বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের সামনে এসে ধরা দিয়েছে। অবিশ্বাস্য গতিতে আমরা টিকা তৈরি করেছি। এমন টিকা তৈরি করতে কয়েক দশক লেগে যেত। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে দ্রুত এই টিকা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে, মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

এখন বৈরী সময়। নানাভাবে আমরা বিভক্ত। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে বিভাজনের মতো এই সংকটকে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। তবে এটা সহজ নয়। তাই আমি বলব, পরিবার বন্ধুবান্ধব পর্যায় থেকেই এ নিয়ে কাজ শুরু হোক। একটা বিষয় মনে রাখবেন, কাউকে উপদেশ দেবেন না, কারও তুলনামূলক বিচার করবেন না। প্রশ্ন করুন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন। প্রশিক্ষণ, চর্চার মাধ্যমে আপনি যা জানতে পেরেছেন, সে সম্পর্কে তাঁদের মত কী, জানার চেষ্টা করুন। মানুষ যখন আপনাকে বিশ্বাস করে, তখন তাঁরা এটাও মনে করে যে আপনিও তাঁদের কথা শুনবেন। তাই তাঁদের সঙ্গে কথা বলুন।

আমি যখন স্নাতকের শিক্ষার্থী, তখন আমাদের জন্য বড় ইস্যু ছিল ভিয়েতনাম আর মানবাধিকার। এই আন্দোলনে খুব বেশি অংশগ্রহণ আমার ছিল না। সেই সময় পড়াশোনাতেই আমি বেশি সক্রিয় ছিলাম। বেশির ভাগ সময় আমি তখন গবেষণাগারে কাটাতাম। তখন যা ঘটছিল সে সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতাম। তবে আমার একটি লক্ষ্য ছিল এবং আমার একটি স্বপ্ন ছিল। আমাকে একটি পথ বেছে নিতে হয়েছিল। আপনাদেরও এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। এসব ক্ষেত্রে আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কারণ, আমাদের যেমন অধিকারকর্মী দরকার, তেমনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এমন মানুষও দরকার। আপনার অবস্থান কোনটি হবে, আপনাকেই বেছে নিতে হবে।

আপনাদের জন্য আরেক উপদেশ হলো ‘না’ বলতে শিখুন। এটা খুব কঠিন কাজ। আমিও অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম। আমি আমার সময়টা কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটু লক্ষ করুন, সব ক্ষেত্রে আপনি ‘না’ বলতে পারবেন না। আবার কোনো কিছুতেই যদি ‘না’ বলতে না পারেন, তবে আপনি হয়তো এগিয়ে যাবেন; কিন্তু একটা সময় আপনি হেরে যাবেন। তাই বিনয়ের সঙ্গে ‘না’ বলতে শিখুন। বলতে শিখুন, ঠিক এ মুহূর্তে এই কাজ করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। আমার আরও কাজ আছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত