তিনি মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মানুষ হিসেবেও লোকে তাঁকে চিনত। তবে নিজেকে এখন মানবহৈতিষী হিসেবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন বিল গেটস। ১৩ মে যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন অ্যারিজোনা ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি।
তোমাদের মতো এমন সমাবর্তন নেওয়ার সুযোগ আমার কখনো হয়নি। সমাবর্তন বক্তৃতা আমি শুনিনি। তাই ভাবছিলাম, না দেখা-না শোনা সেই সমাবর্তন বক্তৃতায় আমি আসলে কী কী চাইতাম? যে কথা আমার শোনার সৌভাগ্য হয়নি, সে রকম পাঁচটি বিষয় আজ তোমাদের বলব।
১.
প্রথম কথা হলো, তোমার জীবন কোনো একাঙ্ক নাটক নয়।
ক্যারিয়ারের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তুমি হয়তো এখন ভীষণ চাপে আছ। মনে হতে পারে, এই সিদ্ধান্তগুলো বুঝি আর বদলানোর সুযোগ নেই। আদতে তা নয়। কাল, কিংবা আগামী ১০ বছর তুমি যা করবে, বাকি জীবনও তোমাকে তা-ই করে যেতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।
যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলাম, ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা মাইক্রোসফটেই কাজ করব।
আজ, এখনো সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে। কিন্তু আমি মনে করি আমার পূর্ণকালীন চাকরি হলো মানুষের কল্যাণে কিছু করা। নতুন উদ্ভাবন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানা খাতে বৈশ্বিক অসমতা কমানো—এসব নিয়ে আমার দিন কাটে এখন। অতএব বলব, ভবিষ্যতে পেশাবদলের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব স্বাভাবিক। এটা খুব ভালো কিছুও বয়ে আনতে পারে।
২.
দ্বিতীয় যে উপদেশ আমার সমাবর্তনে শুনতে পেলে ভালো লাগত, তা হলো—দ্বিধায় না ভোগার মতো অতটা চৌকস তুমি কখনোই হয়ো না।
কলেজ পেরোনোর সময় ভেবেছিলাম, যা কিছু জানা দরকার—সবই আমি জানি। কিন্তু শেখার প্রথম ধাপ হলো, কী জানি তা নয়, বরং কী জানি না, তার ওপর জোর দেওয়া।
ক্যারিয়ারের কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন সমস্যায় পড়বে, যেটা তুমি নিজে সমাধান করতে পারবে না। ঘাবড়ে যেয়ো না। লম্বা করে দম নাও। ভাবো। আর অভিজ্ঞ মানুষের পরামর্শ নাও।
তোমার কোনো সহকর্মী হতে পারে পরামর্শক, যাঁর অভিজ্ঞতা তোমার চেয়ে বেশি; কিংবা তোমার কোনো বন্ধু, যে তোমাকে ভিন্নভাবে ভাবার পথ দেখাতে পারে। মানুষটি কোনো বিশেষজ্ঞও হতে পারেন, যিনি হয়তো মেসেজের মাধ্যমে তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে আগ্রহী হবেন।
জীবনে এত কিছু যে পেয়েছি, তার কারণ সেই মানুষগুলোর কাছে আমি গিয়েছি, যাঁরা আমার চেয়ে বেশি জানেন। মানুষ তোমাকে সাহায্য করতে চায়। সাহস করে তোমাকে শুধু সাহায্যটা চাইতে হবে।
তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ। কিন্তু বাকি জীবনটাকেও তোমার শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্র হিসেবেই নেওয়া উচিত।
৩.
আমার তৃতীয় উপদেশ: সেসব কাজে মনোযোগ দাও, যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করে।
সুখবর হলো, তোমরা এমন এক সময়ে স্নাতক হচ্ছ, যখন সমাধান খোঁজার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সামনে আছে। নতুন শিল্পকারখানা, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব জায়গায় তুমি জীবিকা নির্বাহ এবং পরিবর্তন আনার সুযোগ খুঁজে পাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ বড় ধরনের ভূমিকা রাখার কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছে।
যেমন তোমরা অনেকেই হয়তো বনকর্মী হবে। কীভাবে অত্যাধুনিক ড্রোন কাজে লাগিয়ে বনের নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায়, শিক্ষকেরা নিশ্চয়ই তোমাদের শিখিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই প্রযুক্তি তোমাকে সাহায্য করবে।
তোমরা অনেকে প্রোগ্রামার হিসেবে পেশাজীবন শুরু করতে যাচ্ছ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে মানুষ কীভাবে উপকৃত হতে পারে, তা নিয়ে কাজ করতে পারো।
যখন কোনো বড় সমস্যার সমাধানের পেছনে সময় দেবে, তখন নিজের সেরাটা দেওয়ার স্পৃহা পাবে। এটা তোমাকে আরও সৃজনশীল করবে। জীবনের একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাবে।
৪.
চতুর্থ উপদেশটা সহজ: বন্ধুত্বের শক্তিকে খাটো করে দেখো না।
আমি যখন ছাত্র ছিলাম, এমন একজন বন্ধু পেয়েছিলাম, যার সঙ্গে আমার পছন্দগুলো মেলে। যেমন বিজ্ঞান কল্পকাহিনি, কিংবা কম্পিউটারবিষয়ক সাময়িকী।
তখনো জানতাম না, এই বন্ধুত্ব আমার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমার সেই বন্ধুর নাম পল অ্যালেন। আমরা একসঙ্গে মাইক্রোসফট শুরু করেছিলাম।
মনে রেখো, যার পাশে বসে লেকচার শুনেছ, সে শুধুই তোমার সহপাঠী নয়। এরাই তোমার ‘নেটওয়ার্ক’। তোমার ভবিষ্যতের সহপ্রতিষ্ঠাতা কিংবা সহকর্মী। এই মানুষগুলোর কাছ থেকেই তুমি সাহায্য, তথ্য, পরামর্শ পাবে। এই মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার পরও তোমার সবচেয়ে মূল্যবান সঙ্গী হবে সে-ই, যাঁর সঙ্গে মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলে।
৫.
শেষ পরামর্শটা আমি সবচেয়ে বেশি বলি। এটা বুঝতে আমার অনেকটা সময় লেগে গেছে। আর তা হলো: কাজ না করা মানেই এই নয় যে তুমি অলস।
তোমার মতো বয়সে আমি ভাবতাম, ছুটি বলে কিছু নেই। আমার আশপাশের সবাইকে অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করতে বলতাম। মাইক্রোসফটের শুরুর দিনগুলোতে আমি পার্কিংয়ের জায়গায় নজর রাখতাম। খেয়াল করতাম, কে আগে চলে যাচ্ছে আর কে রাত পর্যন্ত কাজ করছে।
কিন্তু যখন বয়স হলো, বিশেষ করে যখন বাবা হলাম, তখন বুঝলাম জীবনে কাজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু আছে।
এই শিক্ষা পেতে আমার যতটা সময় লেগেছে, তোমরা এত সময় নিয়ো না। সম্পর্কের যত্ন নাও। সাফল্য উদ্যাপন করো। খারাপ সময় কাটিয়ে ওঠার পেছনে সময় দাও।
যখন প্রয়োজন, তখন বিরতি নাও। তোমার আশপাশের মানুষের যখন বিরতি প্রয়োজন, তখন তাঁকে সেই সুযোগটা দাও।
জীবনের পরের ধাপে পা রাখার আগে নিজেকে একটু সময় দাও, মজা করে নাও। হতে পারে আজ রাতে, সপ্তাহান্তে, গ্রীষ্মের ছুটিতে, যখন সুযোগ পাওয়া যায়। এই আনন্দ তোমার প্রাপ্য।
২০২৩–এর স্নাতকেরা, ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতে। আমার বিশ্বাস, তোমরাই জলবায়ু সংকটের সমাধান আনবে, ধনী-গরিবের পার্থক্য ঘোচাবে।
এক প্রবল দুঃসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কাটিয়ে তোমরা এরই মধ্যে ইতিহাস গড়েছ। বাকি জীবনেও তোমরা ইতিহাস গড়বে, এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বের আনাচকানাচে কীভাবে তোমরা ইতিবাচক পরিবর্তন আনো, দেখার জন্য আমার আর তর সইছে না। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: গেটস নোটস