শিম্পাঞ্জি নিয়ে গবেষণা করতে এখন রুয়ান্ডার গহিন বনে রয়েছেন বাংলাদেশের হাসান আল-রাজী। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি গবেষণা করছেন তিনি। শিম্পাঞ্জিদের সঙ্গেই এখন কাটে তাঁর মাসের অর্ধেকটা। এই গবেষকের ‘বনবাস’–জীবনের গল্প শুনলেন সজীব মিয়া
পাঁচটা বাজতেই বনে সন্ধ্যা নেমে এল। মেঘলা আকাশ সন্ধ্যার আগমনকে আরও ত্বরান্বিত করল। যে চারটি শিম্পাঞ্জির পিছু পিছু দিনভর ঘুরেছি, তারা এখন পাশাপাশি দুটি গাছে অবস্থান নিয়েছে। তিনটি একটি গাছের মোটা ডালে বসে পড়েছে। দুপাশ থেকে যা পেল, তা–ই টেনে নিয়ে আয়েশ করে শুয়ে পড়ল। এর পরও যখন কারও কারও আরাম হচ্ছিল না, আরও কিছু ডালাপালা ভেঙে গায়ের নিচে দিয়ে দিল। ব্যস, মিনিট পাঁচেকেই হয়ে গেল রাত্রিবাসের জম্পেশ বিছানা।
ঘুমানোর জন্য প্রায় প্রতিদিনই নতুন করে বাসা বানায় শিম্পাঞ্জি। আবহাওয়ার কারণে সেদিন ওদের দিনের কার্যক্রম সীমিত হয়ে গিয়েছিল। তাই কিছুটা আগেভাগেই বিশ্রামে চলে গেল। উঁচু গাছের ডালে বিছানা করার কারণে ওদের আর খুব একটা দেখা গেল না। আমার সঙ্গে দুজন সহযোগী আর একজন ট্রেকার। তাদের সহযোগিতায় দ্রুত যন্ত্রপাতি বের করি। এসব যন্ত্রের মাধ্যমে জায়গাটার তাপমাত্রাসহ বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হবে। বোঝার চেষ্টা করা হবে দিনমান ঘুরে রাতে কেমন পরিবেশে শিম্পাঞ্জিরা ঘুমায়। সতর্কতার সঙ্গে যন্ত্রগুলো লাগিয়ে ক্যাম্পে ফেরার পথ ধরি।
এই ফেরা মানে কিন্তু উঠান থেকে চট করে ঘরে ঢুকে পড়া না। নিউংওয়ে জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ। পানি ঝরে ঝরে পিচ্ছিল হয়ে আছে। ধীরে ধীরে দেখেশুনে হাঁটতে থাকি। ২৩ এপ্রিল। এ দফায় বনবাসের তৃতীয় দিন। জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই দুই সপ্তাহ করে বনে থাকি। বনের মধ্যে শিম্পাঞ্জিরা কীভাবে কী করে, কী খায়, কোথায় কতক্ষণ থাকে—এসবই খেয়াল রাখি। আজও সেসবই করলাম। ক্যাম্পে ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে গেল।
বনের মধ্যে ক্যাম্প
ক্যাম্পে থাকার দুটি কামরা, লাগোয়া রান্নাঘর আর বাথরুম। ঘরের বাইরে তাঁবু টেনে থাকার ব্যবস্থাও আছে। ক্যাম্পে ফিরেই দেখি—ভাত, কাঁচকলা ভাজি আর শিমের বিচি সেদ্ধ করে রেখেছেন পাচক। চার মাস হলো রুয়ান্ডায় আছি। এখনো স্থানীয় বাসিন্দাদের খাবারে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারিনি। অবশ্য ক্ষুধার্ত মুখে সবই অমৃত লাগে। তারপরও প্রতিবার ক্যাম্পে আসার সময় আমার স্ত্রী রান্না করে সঙ্গে দেয়। এবারও মাংস ভুনা করে বাটিতে দিয়েছে। তারই দুই টুকরা অবশিষ্ট আছে। পরিচ্ছন্ন হয়ে খেয়েদেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
যত রাতেই ঘুমাই না কেন, উঠতে হয় ভোরে। ২৪ এপ্রিলও তার ব্যতিক্রম হলো না। তাঁবু থেকে বেরোতেই মাথায় বৃষ্টির ফোঁটা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি মানেই কাজের ব্যাঘাত, বাড়তি খাটুনি। যা ভাবা গিয়েছিল, তা–ই হলো। দুপুরের পর বৃষ্টির জোর এত বেড়ে গেল যে আশপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। রেইনফরেস্ট বা বৃষ্টি–অরণ্যের বৈশিষ্ট্য হলো বৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আবার বাষ্প হয়ে উড়ে যেতে শুরু করে; আর চারপাশ ঘোলা হয়ে যায়। আজও তা–ই হলো। ঘোলাটে পরিবেশে শিম্পাঞ্জির দল কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে তার খবর নেই। বাধ্য হয়ে একটি ভালো জায়গা দেখে গুটিসুটি মেরে বসে পড়লাম।
জঙ্গলের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে কত কথা মনে পড়ে। রংপুর শহরের ছোট্ট একটি পাড়া থেকে আফ্রিকার এই জঙ্গল পর্যন্ত আসার যাত্রাটা তো খুব সহজ ছিল না। নিউংওয়ে জাতীয় উদ্যানের উঁচু-নিচু রাস্তার মতোই তাতে অনেক চড়াই-উতরাই। বনে বনে কেটেছে কত নির্ঘুম রাত। গবেষণার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে কত দিন, হিসাব নেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে পাস করে দেশে উভচর, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী—সবকিছু নিয়েই কমবেশি গবেষণা করেছি। তবে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি প্রাইমেট বা বানর গোত্রীয় প্রাণীদের নিয়ে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে লজ্জাবতী বানর (বেঙ্গল স্লো লরিস) নিয়ে। যে গবেষণার পথ ধরেই আজ নিউংওয়ে জাতীয় উদ্যানে বসে আছি। মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য আছে, এমন একটি প্রাইমেট, শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে এখানে আমার কাজ।
আমাদের নিশাচর লজ্জাবতীরা
২০১৪ সালের শেষ দিকে লজ্জাবতী বানর নিয়ে গবেষণার পরিকল্পনা করি। সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবির বিন মুজাফফরের পরামর্শ ও আর্থিক সহযোগিতায় কাজটা শুরু করি পরের বছর। হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে দুই বছর এই নিশাচর প্রাণীর আচরণগত তথ্য সংগ্রহ করেছি। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত লজ্জাবতী বানরদের পেছনে ঘুরে ঘুরে তাদের প্রতিটি আচরণের তথ্য লিপিবদ্ধ করতাম। তথ্যগুলো কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত ইভল্যুশন, ইকোলজি অ্যান্ড কনজারভেশন অব লোরিস অ্যান্ড পটোস বইয়ে জায়গা পেয়েছে। এরপর দ্য রাফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে সিলেট বিভাগের সাতছড়ি, লাউয়াছড়া, রাজকান্দি, লাঠিটিলা ও আদমপুর বনে লজ্জাবতী বানরের সংখ্যার ওপর জরিপকাজ করি। এই কাজের ফলাফলও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ডাইভার্সিটিতে প্রকাশিত হয়েছে। এখন আমরা জার্মান প্রতিষ্ঠান প্লাম্পলরিসের ব্যানারে লজ্জাবতী বানর গবেষণা এবং সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছি।
আমার গবেষণা কাজ দেখেই বৃত্তিসহ পিএইচডির সুযোগ দেয় ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া। দেশে লজ্জাবতী বানর নিয়ে গবেষণাটা এগিয়ে নিতে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সিরল গ্রুইটার আমাকে তাঁর শিম্পাঞ্জি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে বললেন। অসম্পন্ন কাজটি এগিয়ে নিতে করোনার পর তিনি কোনো গবেষক পাননি। নতুন কিছুতে মেতে থাকার আনন্দে রাজি হয়ে যাই। সেই গবেষণা কাজেই রুয়ান্ডায় এসেছি। এখানে থাকতে হবে এক বছরের বেশি সময়। আমার স্ত্রী মার্জান মারিয়াও বরাবরের মতো সঙ্গে আছেন। এবার তিনি গবেষণা সহকারী। রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে বাসা হলেও আমার মাসের অর্ধেক সময় কাটে নিউংওয়ে জাতীয় উদ্যানের এই ক্যাম্পে। আমাদের ছোট সন্তানের জন্য মার্জান আসতে পারেন না। শিম্পাঞ্জিরা সর্বভুক। একদিন দেখেছি, ছোট একটা বানর শিকার করে ভূরিভোজ করছে। এই উদ্যানে পর্যটকদের আনাগোনা আছে, তাই মানুষের সঙ্গে শিম্পাঞ্জিরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ছোট শিশু দেখে যদি আক্রমণ করে? সেই ভয়ে আর ঝুঁকি নিই না।
নিউংওয়ের শিম্পাঞ্জিরা
শিম্পাঞ্জিরা সাভানা বা তৃণভূমিতে বেশি থাকে। কিছু কিছু বনেও আছে। এর মধ্যে নিউংওয়ে জাতীয় উদ্যানের শিম্পাঞ্জিদের বাস সর্বোচ্চ উচ্চতায়। পাহাড় যত উঁচু হয়, তাপমাত্রা তত কম থাকে। তাই পাহাড়ি এই রেইনফরেস্ট বা বৃষ্টি-অরণ্যের তাপমাত্রায় শিম্পাঞ্জিরা স্বভাবগতভাবে শরীরকে কীভাবে ঠিক রাখে, সেটি আমার গবেষণার বিষয়।
এই গবেষণার জন্য প্রথম বনে প্রবেশ করি গত ১০ জানুয়ারি। সে যাত্রায় সঙ্গে ছিলেন সিরল গ্রুইটার। আগেই ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে আমরা জেনে গেছি শিম্পাঞ্জিরা কোথায় আছে। কয়েক ঘণ্টা বনের মধ্যে হেঁটে সেই জায়গায় এসে দেখা গেল, তারা সরে পড়েছে। গাইডদের সঙ্গে ওয়াকিটকি থাকে। বনে অন্য এক জায়গা থেকে খবর এল শিম্পাঞ্জির একটি দল সেখানে আছে। ওই দলের উদ্দেশ্যে আমরা হাঁটতে শুরু করি। আমার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। এই প্রথম সামনাসামনি শিম্পাঞ্জি দেখব। বইয়ের পাতা আর টিভির পর্দার বাইরে মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকা এই প্রাণীকে আগে কখনো দেখিনি। পাহাড়ি পথে আমরা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেলাম। দেখি, চারটি শিম্পাঞ্জি বটজাতীয় একটি গাছে ঝুলে আছে। এত বড় একটি প্রাণী কীভাবে গাছে ঝুলে ঝুলে ছোট ছোট ফল খাচ্ছে, সেই বিস্ময় আমার কাটে না। গলায় ঝোলানো বাইনোকুলারে চোখ রাখলাম। মুগ্ধতার সঙ্গে দেখতে থাকলাম, শিম্পাঞ্জির চোখ, মুখ, হাত ও নখ। দেখতে দেখতে মনে হলো, মানুষের সঙ্গে কত মিল।
সেটিই ছিল আমার প্রথম শিম্পাঞ্জি দর্শন। এখন তো ক্যাম্পে গেলে প্রায় প্রতিদিনই দেখছি। ছোট ছোট বেশ কিছু দল তো চেনাও হয়ে গেছে। বছরখানেক পর কতটা মায়ায় পড়ে যাই তাদের, সেটি সময়ই বলে দেবে।