ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—তিন আমলেই অভিনয় করা মানুষ মাসুদ আলী খান। মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র—তিন মাধ্যমেই বিচিত্র সব চরিত্রে অভিনয় করে হয়ে উঠেছেন সবার চেনা। গুণী এই অভিনয়শিল্পী গতকাল শুক্রবার পেয়েছেন ‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০২৪’। তাঁর অভিনেতা হয়ে ওঠার গল্প শোনাচ্ছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: বরেণ্য অভিনেতা মাসুদ আলী খান আর নেই। আজ ৩১ অক্টোবর ঢাকায় নিজ বাসায় মৃত্যু হয় এই গুণী অভিনেতার। এ বছরের ২৫ মে তাঁকে নিয়ে লেখাটি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি আবার সামনে আনা হলো।—বি.স.)
মঞ্চে রানাপ্রতাপ সিংহ নাটকের অভিনয় চলছে। মানিকগঞ্জের জামির্ত্তা সত্যগোবিন্দ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে রাত নামলেও হ্যাজাকের আলোয় মাঠটি তখন দিনের চেয়েও উজ্জ্বল। মঞ্চে গুটিসুটি পায়ে উঠল দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট এক ছেলে। অভিনয় আর কী, মঞ্চে উঠে দরাজ গলায় গান গাইল। তাতেই ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
‘গলাডা কী সোন্দর! এইডা কার পোলা?’
‘চিনো না? ধানবাড়িয়ার আরশাদ আলীর পোলা।’
লোকজন যখন এসব বলাবলি করছিল, ছোট্ট বালক মাসুদ তখন উত্তেজনা আর আনন্দে আটখানা। নাটক শেষে সে মেকাআপও তুলল না, বাড়ি ফিরে সে বেশেই ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন স্কুলেও গেল ওই সাজে—যেন বরাবরই সে চারণ বালক!
‘ভবিষ্যতে আমি যে অভিনেতাই হব—সেদিনই বোধ হয় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল,’ বললেন মাসুদ আলী খান। আমাদের দেশের জীবিত অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে তিনিই সম্ভবত এখন সবচেয়ে বয়স্ক। তাঁর বয়স এখন ৯৪ বছর।
‘এত বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন…আপনি তো জাতীয় বাবা’ বলতেই আমাদের সংশোধন করে দিলেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা, ‘না না, বাবা ছাড়িয়ে আমি এখন দাদা।’
১৯৯৯ সালে পেয়েছিলেন প্রথম মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার। আর এবার রজতজয়ন্তীর বছরে পেলেন ‘আজীবন সম্মাননা’। সেই উপলক্ষেই দিন কয় আগে তাঁর গ্রিন রোডের বাসায় গিয়েছিলাম আমরা। ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল শ পাঁচেক নাটকে অভিনয় করা মানুষটি চেয়ারে বসে আছেন। সামনে ওয়াকার। আট বছর আগে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন থেকেই ওয়াকার তাঁর সঙ্গী। বললেন, ‘এখনো অভিনয় করি, তবে শুয়ে শুয়ে। হাঁটতে তো পারি না। কিছু মনে করতেও কষ্ট হয়।’
স্মৃতি মনে করতে কষ্ট হয় বলেই কি পুরোনো ছবির অ্যালবামে খোঁজেন ফেলে আসা দিন? মাসুদ আলী খানের বসার ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল টেবিলে একতাড়া সাদাকালো ছবি। সবই নাটকের। আমাদের হাত থেকে ছবিগুলো নিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন, ‘এই সবই ড্রামা সার্কেলের নাটকের ছবি। এই যে রক্তকরবীর শো…এই যে লায়লা সামাদ… এই যে আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান নাটকে আমি, মাঝখানে কেয়া চৌধুরী, তারপর বুলবুল আহমেদ…আর এই যে কালো চুলে যাকে দেখছেন, সে কে বলুন তো?’
প্রশ্নটি তিনি করলেন, উত্তরও তিনিই দিলেন। এর মধ্যেই এই অভিনেতার মুখে বাঁকা চাঁদের মতো একফালি হাসি ফুটেছে। ভাবছি, কালো চুলের এমন মাসুদ আলী খানকে কি আমরা কখনো দেখেছি!
মাসুদ, মাখন অথবা নিজাম
সনদপত্রে মাসুদ আলী খানের জন্মসাল ১৯৩১। তবে তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, ‘আমার জন্ম এরও দুই বছর আগে, মানিকগঞ্জের পারিল নওধা গ্রামে, নানাবাড়িতে।’
বাবা আরশাদ আলী খান ছিলেন সরকারি চাকুরে। থাকতেন কলকাতায়। মা সিতারা খাতুন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মাসুদ তৃতীয়। মা তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘মাখন’ আর বাবা ‘নিজাম’। আমাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে মানিকগঞ্জের মাঠঘাট আর কলকাতার পথে পথে যেন ছুটে বেড়াচ্ছিলেন বাবা-মায়ের সেই মাখন বা নিজাম।
‘বাবা গান গাইতেন ও লিখতেন। বাদামি রঙের একটা বাঁধানো খাতায় সেই গান তুলে রাখতেন মা। আমাদের বাড়িতে গ্রামোফোন ছিল। আঙ্গুরবালা, হরিমতির গান বাজত। সেসব শুনে শুনে খুব ছোট থেকেই আমি গলায় গান তুলে নিতে পারতাম,’ স্মৃতি হাতড়ে শৈশবে চলে গেছেন মাসুদ। ‘ক্লাস টু পাস করে আমরা কলকাতা চলে গেলাম। দেশভাগের পরের বছর ১৯৪৮ সালে আবার এ বাংলায় ফিরে এলাম। তখন আমি নাইনে পড়ি। মানিকগঞ্জে নয়, কুমিল্লায় বড় বোনের বাড়িতে আমার ঠাঁই হলো। তখন আমি ফুটবল খেলি আর গলা ছেড়ে গাই, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে তোমারে করেছে রানী।’
তাহলে কি নাটক তাঁর জীবনে ছিল না এ সময়?
মাথা ঝাঁকালেন মাসুদ আলী খান, ছিল। স্কুলের বার্ষিক নাটকগুলোতে তিনি ছিলেন অপরিহার্য অভিনেতা। আর কুমিল্লাবাসের সময় ভার্নাল থিয়েটারের সাহজাহান নাটকেও অভিনয় করেছিলেন।
প্রেম এসেছিল নীরবে
১৯৪৯ সালে মাধ্যমিকের পর উচ্চমাধ্যমিক পড়তে চলে এলেন ঢাকা। তবে এর আগে তাঁর জীবনে ‘প্রেম এসেছিল নীরবে’। কুমিল্লায় যে বাড়িতে থাকতেন, তার মালিকের মেয়ে রুবী। তাঁকে দেখে তরুণ মাসুদ আলী খানের মনে অনুরাগ জন্মাল। কিন্তু রুবীকে মুখ ফুটে কখনো বলতে পারেননি সে কথা।
মজার ব্যাপার হলো, ১৯৫৫ সালে তাহমিনা খান নামে যাঁকে বিয়ে করেন, তাঁর ডাকনামও রুবী! ‘নামের কারণেই বোধ হয় তাঁর প্রেমে পড়েছিলাম,’ বলতে বলতে হেসে ফেললেন মাসুদ আলী খান। তাঁর স্ত্রী তখন পাশে বসে হাসিমুখেই শুনছিলেন এ গল্প।
ঢাকায় ‘বখে’ যাওয়া
‘ঢাকায় আজিমপুরে বড় ভাই মাহবুব আলী খানের মেসে এসে উঠলাম।’ পড়াশোনার পাশাপাশি এ সময় ডাক ও টেলিফোন বিভাগে কাজও জুটিয়ে ফেললেন। ‘পড়াশোনা লাটে উঠল। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিলাম না। সবাই বলল, আমি বখে গেছি।’
এক বছর বাদে ১৯৫২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। দুই বছর পর জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ।
সেই ‘বখে’ যাওয়া জীবনেই প্রথম মার্ক্সবাদের সংস্পর্শে আসেন মাসুদ আলী খান। ‘তখন শুধু রাত জেগে পোস্টার মারতাম।’ এর মধ্যেই যুক্ত হন শহীদ সাবের, বদরুল হাসান, ফওজুল করিম, মেসবাহ-উল হক, মন্টু খানদের গড়ে তোলা সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অগ্রণী শিল্পী সংঘ’-এর সঙ্গে।
সেই উত্তাল সময়ের গল্প আরও বিশদে জানতে চাই আমরা। কিন্তু অস্ফুট স্বরে, সলজ্জ ভঙ্গিতে মাসুদ আলী বললেন, ‘কিছুই যে মনে নেই!’
ড্রামা সার্কেলের দিনগুলো
আরও অনেক কিছুই তাঁর মনে নেই । একসময় যে ‘ড্রামা সার্কেল’–এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন, এটা মনে থাকলেও কোথায় মহড়া করতেন, কীভাবে নাটক করতেন এবং কোন কোন প্রযোজনায় অংশ নিয়েছেন—এসব আর সেভাবে মনে নেই।
হেদায়েত হোসাইন মোরশেদের ‘ড্রামা সার্কেল: প্রসঙ্গকথা এবং একক বজলুল করিম’ লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৫৬ সালে মাকসুদুস সালেহীন ও বজলুল করিম গড়ে তোলেন ড্রামা সার্কেল। দলটিকে বলা হয় ঢাকার প্রথম আধুনিক নাট্যদল। প্রায় শুরু থেকেই দলটির সঙ্গে ছিলেন মাসুদ আলী খান। ড্রামা সার্কেলের হয়ে রক্তকরবী, বহিপীর, রাজা ও রাণী, ইডিপাস, আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান, দৃষ্টিসহ বহু নাটকে অভিনয় করেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে দলটি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত এখানে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি ছিল।
অভিনয়ের পাশাপাশি কখনো কখনো নাট্যপরিচালনাও করেছেন তিনি। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদের উদ্যোগে বাংলা একাডেমি মঞ্চে তাঁর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ।
মঞ্চ থেকে ছোট-বড় পর্দায়
১৯৬৪ সালে ঢাকায় টেলিভিশন স্থাপিত হওয়ার পর পর নূরুল মোমেনের নাটক ভাই ভাই সবাই দিয়ে ছোট পর্দায় মাসুদ আলী খানের অভিষেক। আর সাদেক খানের নদী ও নারী দিয়ে বড় পর্দায় হাতেখড়ি। এই চলচ্চিত্রে নায়ক আসগর চরিত্রে অভিনয় করে সবার নজর কাড়েন।
এরপর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে একের পর এক বৈচিত্র্যময় নানা চরিত্র করে চেনামুখ হয়ে ওঠেন মাসুদ আলী খান।
অনেক সিঁড়ি পেরিয়ে
ব্যক্তিজীবনে এই অভিনেতার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে মাহমুদ আলী খান যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী। আর মেয়ে নাজমা খান ধানমন্ডির বাসিন্দা। চাকরিজীবনে সরকারের নানা দপ্তরে কাজ করেছেন তিনি। ১৯৬২ সালে শুরু করেন পর্যটন করপোরেশনের চাকরি। আর ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সচিব হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন আরও এক যুগ। এর পর থেকে অভিনয়ই তাঁর ‘পেশা’। আলাপের শেষ বেলায় হাসির ছলে যেমনটা বললেন, ‘অভিনেতার চাকরি করি।’