বিশ্বজুড়েই সামাজিক মাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সারদের রাজত্ব চলছে। কারও কয়েক হাজার, কারও কয়েক লাখ তো কারও আবার কয়েক মিলিয়ন অনুসরণকারী। পোশাক, স্টাইল, সাজ দিয়ে অনুসরণকারীদের সামনে নিজেদের তুলে ধরছেন তাঁরা। উপার্জনও করছেন এর মাধ্যমে। বাংলাদেশের এমন ২ জন ইনফ্লুয়েন্সার জানালেন সাধারন ব্যক্তি থেকে ইনস্টাগ্রামের ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে ওঠার গল্প।
বড় পর্দার তারকা নন তাঁরা, ছোট পর্দাও তাঁদের ক্ষেত্র না—ইনফ্লুয়েন্সারদের জগৎ আলাদা। তাঁরা ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ফেসবুক দুনিয়ার বাসিন্দা। সাধারণ একজন ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী প্রথম দিকে নিজের ব্যক্তিগত স্টাইলটাই তুলে ধরেন। সবার সঙ্গে ভাগ করে নেন নিজের পোশাক, ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ বা রূপচর্চার তথ্য। তিলে তিলে গড়ে ওঠে ভক্তকুল। সামাজিক মাধ্যমে প্রথম ছবিটি দেওয়ার সময় তাঁরা হয়তো ভাবতেও পারেননি যে একসময় তাঁরাই হয়ে উঠবেন ইনফ্লুয়েন্সার।
ভালো লাগার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ইনফ্লুয়েন্সার আর অনুসরণকারীর সম্পর্ক। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নির্ধারণ হয়ে যায় অচেনা কেউ অনুসারীর তালিকায় আসবেন, কি আসবেন না। সবাই কিন্তু প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। স্টাইল, ব্যক্তিত্ব, ভিন্নভাবে নিজেকে উপস্থাপন ইত্যাদি বিষয় প্রভাবিত করতে সহায়তা করে। কেউ হয়তো ফ্যাশন হাউসের পোশাক তুলে ধরেন, কেউ–বা সাজের কোনো পণ্য। পছন্দের ইনফ্লুয়েন্সারের পরা পোশাক দেখেই অনেকে সেটা কিনতে চান। নির্দিষ্ট কোনো ব্র্যান্ডের বিক্রি বা সুনাম যত বেশি বাড়াতে পারেন একজন ইনফ্লুয়েন্সার, তত বৃদ্ধি পেতে থাকে তাঁর কদর। তবে এখানে বেশ ভূমিকা রাখে বিশ্বাস। পছন্দের ইনফ্লুয়েন্সার কোনো একটা পণ্য যখন তুলে ধরেন, ভক্তরা কেনেন। মান যদি ভালো না হয়, সে ক্ষেত্রে ভক্তকুল দু-চার কথা শুনিয়ে অনুসরণকারীর তালিকা থেকে বেরও হয়ে যান।
অনেকে নিজের দৈনন্দিন জীবনের মুহূর্ত, শখ দিয়ে শুরু করেন। ধীরে ধীরে ভক্তকুল বাড়ায় হয়ে যান ইনফ্লুয়েন্সার। যেমন বাংলাদেশের সোবিয়া আমিন। মূলত তিনি স্থপতি। শুরুতে শখ করে শুধু বেকিংয়ের নানা রকম কনটেন্টই শেয়ার করতেন। করোনাকালে বোনের বিয়ে উপলক্ষে ভারতের বিখ্যাত ডিজাইনার মাসাবা গুপ্তার একটা পোশাক পরে বেশ কয়েকটি ছবি পোস্ট করেছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই পোস্টই পরে শেয়ার করেন স্বয়ং মাসাবা। ব্যস, সেই থেকে শুরু। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ইতিমধ্যে ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। সম্প্রতি হারপারস বাজার-এর প্রচ্ছদেও জায়গা করে নিয়েছেন ঢাকার এই স্থপতি ও মডেল।
আগে থেকেই যাঁরা অন্য কোনো পেশায় তারকাখ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁরাও কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে আছেন। অনেকে আবার মডেলিং দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন, সেখানে সুনাম অর্জন করার পাশাপাশি ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবেও বিখ্যাত হন। টাইম সাময়িকীর ২০২৩ সালের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির একজন মডেল বেলা হাদিদ। ফিলিস্তিনি-আমেরিকান এই সুপারমডেল মানসিক স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, সরকারি নিপীড়ন এবং নাগরিক অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের সাজপোশাকের পাশাপাশি সামাজিক নানা বিষয়ে কথা বলে প্রশংসিত হয়েছেন ২৬ বছর বয়সী। ৬ কোটি অনুসরণকারীর কাছে তিনি বেশ প্রভাবশালী ইনফ্লুয়েন্সার।
ইনস্টাগ্রামে পরিচিত: kingtisha_08
স্টাইল করে পোশাক পরে ছবি তোলা পছন্দ করেন আসমাউল হোসনা। ইনস্টাগ্রাম দুনিয়ায় তিশা নামেই তাঁকে চেনে বেশি। ইনস্টাগ্রামে ভ্লগিং শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর অনুসরণকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার, এখন ১ লাখের বেশি। শুরুর দিকে নিজের ছবি দিতেন উদ্দেশ্যবিহীনভাবে। ছোটবেলায় নিজের পোশাক নিজেই তৈরি করতেন। ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ার ইচ্ছা ছিল। স্টাইল করতেন নানা দেশের তারকাদের দেখে। ২০১৮ সালে প্রথম ব্র্যান্ড কোলাবোরেশনের বিষয়টি মাথায় আসে। ইনস্টাগ্রাম থেকে এভাবেই উপার্জন শুরু। যে কাজ করতে ভালো লাগে, সেটা থেকে টাকাও উপার্জন করা শুরু করলেন।
কীভাবে সাজতে পছন্দ করেন বা ইনস্টাগ্রামে ছবি দেওয়ার সময় কী ধরনের সাজ বেছে নেন, জিজ্ঞাসা করায় বলেন, ‘সবার পক্ষে তো লাখ লাখ টাকার কাপড় কিনে পরা সম্ভব নয়। আমার কাছে মনে হয়েছে মার্জিত পোশাকেও স্টাইল করা যায়। আমি যখন সাজি, আরামকে গুরুত্ব দিই। মুক্তার মালা, প্যাস্টেল রং পছন্দ করি। সাদা রঙের পোশাক পরা হয় বেশি।’ পাঁচটি জিনিস কিনে সেটা দিয়েও অনেক ধরনের স্টাইল করা যায়। পাশাপাশি মূল যে রংগুলো আছে, সেগুলো দিয়েও নানাভাবে স্টাইল করা সম্ভব। এর মাধ্যমে টেকসই ফ্যাশনের বিষয়টিও পোক্ত হয়।
এ পর্যন্ত ৬০টির বেশি ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন। সাধারণত নিজের মেকআপ নিজেই করেন। পোশাকের বাইরে মোবাইল প্রতিষ্ঠান, দারাজ, ইন ড্রাইভের সঙ্গে কাজ করছেন। ইচ্ছা আছে নিজের একটা ফ্যাশন হাউস করবেন।
ইনস্টাগ্রামে পরিচিত: Fariha.tasnim
ইনস্টাগ্রামে ১ লাখ ১১ হাজার মানুষের নজরে থাকা ফারিহা তাসনিমকে কাছের মানুষেরা ডাকেন অরিন। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন উকিল হবেন। তবে আজকাল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছেন। পাশাপাশি পুরোদমে ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে কাজ করছেন। তবে শুরুটা ছিল ভিন্ন।
মায়ের আগ্রহে খুব ছোটবেলা থেকেই শিখেছেন নাচ। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে রপ্ত করেছেন কত্থক। বিটিভির একটি আয়োজনে নেচে জীবনের প্রথম উপার্জন হিসেবে পেয়েছিলেন আট শ টাকার একটি চেক। এখনো সেটি খরচ করেননি।
২০২০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় করোনার বিধিনিষেধ। সে সময় শখের বশেই নাচের ভিডিও করে ইনস্টাগ্রামে দিতে শুরু করেন অরিন। সাড়াও পাচ্ছিলেন বেশ। এরপর নাচের পাশাপাশি মেকআপ টিউটোরিয়াল, পোশাকের স্টাইলিং ইত্যাদির ভিডিও, ছবি দিতে থাকেন অরিন। বলছিলেন, ‘শুরুতে শুধু সময় কাটাতেই ইনস্টাগ্রামে আসি। এটাই যে একসময় আমার পেশা হয়ে উঠবে, কল্পনাও করিনি।’ সে বছরের শেষ দিকে ইউনিলিভারের একটি বিজ্ঞাপনের কাজ পেয়ে যান অরিন। মানুষ পছন্দ করায় আর আটকে থাকতে হয়নি। ছোট-বড়, নতুন-পুরোনো নানা ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করলেও স্বতন্ত্রভাবে কিছু তৈরি করতেই বেশি আগ্রহী তিনি। অরিন বলেন, ‘নতুন অবস্থায় অনেকেই শোষণ করতে চেষ্টা করে। সময়ের সঙ্গে বুঝতে পেরেছি, কী করা উচিত এবং কী নয়।’ ইনস্টাগ্রাম দুনিয়ায় একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে লাখের বেশি মানুষের উৎসাহ পেতে অরিনের সময় লেগেছে তিন বছর। জানালেন, প্রিয় পোশাক শাড়ি। তবে চলাফেরার সুবিধা ও গরম আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে বেশির ভাগ সময় প্যান্ট ও টি–শার্ট পরেন। অরিনের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রেরণা তাঁর মা। সফলতাকেই আনন্দের উৎস ভাবেন ২১ বছর বয়সী এই তরুণী।