আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। বর্তমান শিক্ষার্থীরা তো বটেই, পুরোনো ছাত্রছাত্রীদের অনেকেও আজ হাজির হবেন প্রিয় ক্যাম্পাসে। তবে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী যাঁরা, তাঁরা কি আদৌ কখনো ক্যাম্পাস ছাড়তে পারেন? মন তো ঠিকই পড়ে থাকে সেই সবুজ নগরে। কেন জাহাঙ্গীরনগরের সংস্কৃতি একটু আলাদা? বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে পুরোনো একটি লেখা প্রকাশিত হলো আরও একবার।
এখনো আমি রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটি! হাঁটতে চাই অন্তত। যতই ভাবি, আর না, রাস্তার এক কোণ ধরেই হাঁটব, কিন্তু একটু অন্যমনস্কতায় বেয়াড়া পা দুটি কেন যে মওকা পেলেই রাস্তার মাঝখানে চলে যায়! তাই পথ চলতে হ্যাপাও হয় বিস্তর। প্রায়ই শুনতে হয়, ‘মাঝপথে হান্দায়ছেন ক্যা, চোক্ষে দেখেন না!’
‘চোক্ষে’ দেখলেও বারবার পা চলে যায় ব্যস্ত ঢাকার রাস্তার মাঝবরাবর।
ঢাকায় থিতু হয়েছি অনেক বছর। তবু এই মাঝরাস্তায় হণ্টনের ‘ঝামেলা’ আমার গেল না। অভ্যাসটি হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। এই ক্যাম্পাসে পড়ার সময় বরাবরই আমরা বুক চিতিয়ে মাঝরাস্তা দিয়ে হাঁটতাম। ভাবটা এমন, রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন সব আমাদের দেখে থেমে যাবে; এবং তা যেতও।
জাহাঙ্গীরনগরে পড়া ছেলেমেয়েদের কীভাবে চেনা যাবে—এমন প্রশ্নে একবার আমাদের এক শিক্ষক বেশ রসিয়ে বলেছিলেন, ‘যখন দেখবে রাস্তার মাঝখান দিয়ে কেউ হাঁটছে, ধরে নিতে পারো সে জাহাঙ্গীরনগরে পড়েছে, জাহাঙ্গীরনগরের সে ‘জাহাঙ্গীর ভাই’।
আদতেই আমরা ‘জাহাঙ্গীর ভাই’, শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে বড়–ছোট—সবাই–ই আমরা একে অপরের ‘ভাই’। এই ‘ভাই সংস্কৃতি’ আর জাহাঙ্গীরনগর যেন অবিচ্ছেদ্য।
৬২০ একরের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরে সব শিক্ষার্থী এখানকার বিভিন্ন হলে থাকার কারণে তাঁদের মধ্যে অন্তরঙ্গ চেনাজানা ঘটে, সবাই যেন অজান্তেই অদৃশ্য এক পারিবারিক বন্ধনে জড়িয়ে যান। আর নিজেদের মধ্যকার এই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা জাহাঙ্গীরনগরে পড়ুয়া ‘জাবিয়ান’রা যে আজীবন বহন করেন, এটাও সত্য। যে কারণে বাইরের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘জাহাঙ্গীরনগর এক বিরাট কোরাম। এক জাহাঙ্গীরনগর আরেক জাহাঙ্গীরনগরকে ডেকে আনেন।’
কথা যে তাঁরা একেবারে ঝুটা বলেন, তা তো নয়। আমাদের সবুজ ক্যাম্পাসের প্রান্তিক, ডেইরি, ট্রান্সপোর্ট, বটতলা বা এখনকার টারজান পয়েন্ট—এসব স্থানে বছরের পর বছর ধরে যে ‘ভাই কালচার’, যে আড্ডার আবহ, তার কারণে আমরা যেমন প্রেমে ও অপ্রেমে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকতে পারি, তেমনি শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা ক্যাম্পাসে নিজেদের ‘রাজা’ও ভাবতে পারি। ফলে এখানে রাস্তা থামিয়ে দেওয়ার মতো ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা ঘটাতে পারি আমরা। আবার এই ‘ভাই কালচার’–এর দরুন যেকোনো অব্যবস্থাপনা বা পীড়নের বিরুদ্ধে যূথবদ্ধভাবে সোচ্চার হতেও এখানে সময় লাগে না। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, এসব ঘটনায় কেবল বর্তমান ছাত্রছাত্রীরাই নন, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরাও কীভাবে কীভাবে যেন যুক্ত হয়ে যান। জাহাঙ্গীরনগর মূলত একটি পরম্পরার নাম। এই পরম্পরার কারণও একটাই—‘ভাই কালচার’।
সে এক নীরব গ্রাম। সব ঋতুতেই প্রকৃতির অপরূপ রূপবদল ঘটে যেখানে; যে স্থানে দিনরাতের প্রতিটি ক্ষণকেই আলাদাভাবে অনুভব করা যায়; মনে হয়, এই লেক আর পাখপাখালির দিকে তাকিয়ে থেকেই তো পার করা যাবে গোটা জীবন...আহা রে...আহা রে...। নাগরিক সুবিধার ছোঁয়ার মধ্যে থেকেও ‘আহা রে’ বলা এক অন্য রকম জীবনের নাম জাহাঙ্গীরনগর।
জাহাঙ্গীরনগর ছেড়ে এসেছি বছর দশেক হলো। তারপরও মায়াবী এই নগরের স্মৃতি এখনো মাঝেমধ্যেই বলক তোলে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় ক্যাম্পাসে।
এখনো যখন কোনো বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁদের কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন থাকে, ‘আপনি কোন ব্যাচ? আমি ৩৪।’
এরপর তাঁর সঙ্গে আপনি থেকে ‘তুমি’তে নামা সময়ের ব্যাপারমাত্র। তারপর আরেক ধাপ নেমে কখন যে তাঁকে ‘তুই’ বলে ফেলি, এর পরেই না শান্তি হয় জাবিয়ানদের।
‘ভাই কালচার’–এর সুবাদে গাছগাছালিতে ছাওয়া ক্যাম্পাসটিতে ‘তুই কালচার’ও রমরমা। জাহাঙ্গীরনগরের কোনো সিনিয়রের কাছে জুনিয়র মানেই ‘তুমি’ অথবা ‘তুই’।
এই ক্যাম্পাসের আরেকটি বড় সংস্কৃতি হলো ‘ব্যাচ কালচার’। জাহাঙ্গীরনগরের পরিচয় পেলেই আমরা পরস্পরকে ব্যাচ জিজ্ঞেস করি। এরপর সব জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রছাত্রীর ক্ষেত্রেই যা হয়, মঞ্চস্থ হয় সেই একই নাটক—বটতলায় কে কীভাবে আড্ডা দিতেন, আমরা কি বটতলার রাজ্জাকের দোকানে খেতাম, খাবারের দোকানে ‘গ্যাটিস’ (খাবার খাওয়ার পর বিনা মূল্যে অতিরিক্ত আরেকটু খাবার জাহাঙ্গীরনগরে ‘গ্যাটিস’ নামে পরিচিত) দেওয়ার চল ছিল, এখনো কি আছে, বাঙালির দোকানে কি এখনো রাতভর আড্ডা বসে, গিটার বাজিয়ে গান করে ছেলেরা—এভাবে টাইম মেশিনে চেপে আমরা পরস্পর যেন ফিরে যাই নিজের নিজের জাহাঙ্গীরনগরের সময়ে।
তারও পরে ঘটে চেনা আরেকটি ঘটনা—জাহাঙ্গীরনগরের যাঁর সঙ্গে মাত্র পরিচয় ঘটল, সেই সদ্য পরিচিত মানুষটিই হয়ে ওঠেন আমার ‘ভাই’। আর তাঁর কাছে আমি কখনো ‘তুই’, কখনোবা ‘তুমি’—জাহাঙ্গীরনগরের ‘ভাই কালচার’–এর বড় সুবিধা হলো, ক্যাম্পাসে যাঁর সঙ্গে কখনো দেখাই হয়নি, মুহূর্তের পরিচয়ে তিনি ‘ভাই’ হয়ে ওঠেন। আপন ভেবে পাশে দাঁড়ান। আর আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট যা–ই আসুক, পরস্পরকে আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, ‘কী রে, কই যাস...প্যাড়া নাই, চিল!’