সবাই যখন ঘুমে, সাজ্জাদ হোসেনের দৌড় শুরু হয় তখন। প্রতিদিনই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছোটেন ভেটেরিনারি মেডিসিনের এই শিক্ষার্থী। শুধু যে বিভিন্ন ম্যারাথনে অংশ নিয়ে পুরস্কার জিতেছেন, তা নয়; পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতনতা তৈরিতেও কাজ করেন তিনি। অনলাইনে শেখান ফিট থাকার কৌশল। পড়ুন এক তরুণ দৌড়বিদের গল্প।
‘তোর শরীরে দেখি কিছুই নাই। ছেলে মানুষ এত হ্যাংলা-পাতলা হলে চলে!’
‘এসব দৌড়ানো বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মন দাও।’
এ রকম কত যে নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। তবু সাজ্জাদ হোসেনের দৌড় থামেনি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগের শেষ বর্ষের এই শিক্ষার্থী ছুঁয়েছেন একের পর এক ফিনিশিং লাইন। দৌড় তাঁর কাছে শুধুই ক্রীড়া নয়, দৈনন্দিন জীবনযাপনেরই একটা অংশ।
কিন্তু দৌড়ে এত আগ্রহই-বা কেন? কেন ক্রিকেট বা ফুটবল নয়? সাজ্জাদের ঝটপট উত্তর, ‘কারণ দৌড় শুরু করতে দলের অপেক্ষায় থাকতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকেই বুঝে গিয়েছিলাম, বেশির ভাগ তরুণই খেলাধুলা নিয়ে খুব একটা আগ্রহী না। হয়তো পড়ালেখার কারণেই। তাই দলগত খেলার চিন্তা বাদ দিতে হলো। দৌড়াতে যেহেতু ভালো লাগত, এটাতেই মনোযোগ দিলাম। নিয়মিতই ক্যাম্পাসজুড়ে ছুটতাম। কিন্তু সামনে উদাহরণ হিসেবে তেমন কেউ ছিল না। নিজে নিজে শিখতে গিয়ে পড়তে হয়েছে বিভিন্ন ইনজুরিতে। আবার উঠে দাঁড়িয়েছি।’
অনেকে হয়তো শুনে অবাক হবেন, দৌড় কিন্তু বেশ ব্যয়বহুল একটি ক্রীড়া। কারণ, অক্লান্ত পরিশ্রমের পর শরীর ঠিক রাখতে দরকার পুষ্টিকর খাবার। পেশাদার খেলোয়াড়দের সঙ্গে পাল্লা দিতে লাগে ঠিকঠাক জুতো। এ দুইয়ের অর্থ জোগাতে শুরুতে টিউশনি করতেন সাজ্জাদ। একসময় সাফল্য আসতে থাকে। ২০২০ ও ২০২১ সালে পরপর দুবার ঢাকা হাফ ম্যারাথনে চ্যাম্পিয়ন হন এই তরুণ। ২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পসের ম্যারাথনে জেতেন স্বর্ণপদক। বিমান বাংলাদেশ হাফ ম্যারাথনের ৭ দশমিক ৫ কিমি বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু ঢাকা ম্যারাথনে প্রথমবার অংশ নিয়েই পঞ্চম হন। পেশাদার বাহিনীর খেলোয়াড়দের বাইরে তিনিই দ্রুততম সময়ে ম্যারাথন শেষ করেন।
প্রতিদিন ক্যাম্পাসের চেনা রাস্তায় ভোরবেলা দৌড়ের চর্চা করেন সাজ্জাদ। গাছপালা থেকে ভোরের পাখি—সবার সঙ্গেই একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। শুরুর দিনগুলোতে সাহস জুগিয়েছেন দৌড়বিদদের গ্রুপ বিডিরানার্সের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তবে শেখানোর হাতেখড়ি হয়েছে ‘অ্যাথলেটিকস অ্যান্ড লিডারশিপ পারফরম্যান্স সিস্টেম’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কাজের মাধ্যমে। হাতে-কলমে শেখাতে শেখাতেই প্রশিক্ষক হিসেবে যাত্রা শুরু। সাজ্জাদ বলছিলেন, ‘দেশি-বিদেশি ভিডিও দেখে, ব্লগ পড়ে, সরাসরি কোর্স করে আমি অনেক দিন ধরেই শিখছিলাম। একসময় মনে হলো, এগুলো নতুনদের জানানোর ব্যবস্থা করলে মন্দ হয় না। শুরুতে ফেসবুকে লিখতাম। এরপর ইউটিউবে ভিডিও বানানো শুরু করি। ভিডিও দেখে অনেকেই আরও ভালোভাবে শিখতে চাইতেন। তাই অনলাইনে শেখানোর সূচনা হয়। আমি হলের রুমে বসে ভিডিও কলে থেকেই ক্লাস নিতাম। মূলত ফিট থাকার কৌশল ও সঠিকভাবে দৌড়ানোর পরামর্শই ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। কীভাবে একটা স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা যায়, সেটা নিয়েও কাজ করতাম।’
এখন সপ্তাহে এক দিন ঢাকায় এসে সরাসরি প্রশিক্ষণ দেন এই দৌড়বিদ। অনলাইন ও অফলাইন মিলিয়ে ৫০ জনের বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আয়োজন করেছেন তিনটি ক্যাম্পের। সম্প্রতি ‘আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিজ্ঞান সংস্থা’ থেকে পেয়েছেন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষকের সনদ।
আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক মেধাবী, প্রতিভাবান। তাদের অনেকের প্যাশন আমাদের অবাক করে। কিন্তু পড়াশোনার চাপে অনেক শিক্ষার্থীই নিজের প্যাশনটা হারিয়ে ফেলে। সাজ্জাদ ভেটেরিনারিবিজ্ঞানের কঠিন পড়াশোনার পাশাপাশি যেভাবে নিজের আগ্রহের জায়গাটা আঁকড়ে ধরে আছে, নিজের পাশাপাশি আরও মানুষকে তৈরি করছে—এটা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার মতো কাজ। ‘আউট অব দ্য বক্স’, অর্থাৎ প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে যে ব্যতিক্রম চিন্তা করা যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের এই ছাত্র। আশা করি, সাজ্জাদের সফলতা আরও তরুণের মধ্যে স্বপ্নের বীজ বুনবে।মো. মাহমুদুল হাসান শিকদার, অধ্যাপক, ভেটেরিনারিবিজ্ঞান অনুষদ এবং ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘ
‘ফিটনেস কোচ’ বিষয়টা কয়েক বছর আগেও হয়তো আমাদের দেশে খুব পরিচিত শব্দ ছিল না। এখন শুধু ক্রীড়াপ্রেমীরাই নন, চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ীদের অনেকেই শরীর ঠিক রাখতে সাজ্জাদের মতো ফিটনেস কোচের শরণাপন্ন হচ্ছেন। বাকৃবির এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘করোনার পরই সম্ভবত স্বাস্থ্যসচেতনতা কিছুটা হলেও বেড়েছে, বিশেষ করে করপোরেট মহলে। যাঁরা চাকরি বা ব্যবসায়িক কাজ নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত থাকেন, তাঁরা স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে সময় বের করে নিচ্ছেন। নির্ভর করছেন কোচের ওপর। শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, অনেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও কর্মীদের ফিট রাখতে চান। তাই পেশা হিসেবে আমার কাজটা এখনো খুব জনপ্রিয় না হলেও সম্ভাবনাময় বলা যায়।’
সাজ্জাদ মনে করেন, কয়েক বছর শিখে-শিখিয়ে প্রস্তুত হতে পারলে অনায়াসেই মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকার বেশি আয় করা সম্ভব। তিনি যেমন পড়ালেখার পাশাপাশি বর্তমানে তালহা গ্রুপে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। দৌড় যে শুধু ক্রীড়া নয়, ফিট থাকার মন্ত্রও—এ চেতনাই সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চান এই তরুণ। সাজ্জাদ স্বপ্ন দেখেন, একদিন অলিম্পিকের ট্র্যাকে ম্যারাথনে দৌড়াবেন। তখন হয়তো তাঁর বার্তাটা ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে অনেক তরুণ প্রথমবারের মতো ঘর ছেড়ে নতুন ঠিকানায় পাড়ি জমান। কেউ হলে থাকেন, কেউ থাকেন মেসে। মায়ের আদর, বাবার শাসন ছাড়া অনেকেই স্বাস্থ্যের প্রতি বেখেয়ালি হয়ে পড়েন। সেই শিক্ষার্থীদের জন্যই ৫ পরামর্শ দিলেন সাজ্জাদ হোসেন।
১. সবার আগে ধূমপান ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।
২. রাত জাগা পরিহার করতে হবে। সেই সঙ্গে সকালে স্বাস্থ্যকর নাশতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
৩. প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪০ মিনিট খেলাধুলা বা ব্যায়াম করা দরকার।
৪. পরিমিত ঘুমের সঙ্গে লাগবে পর্যাপ্ত আমিষ।
৫. প্রতিদিন অন্তত ২.৫-৩ লিটার পানি পান করতে হবে।