সিসাদূষণের কারণে কমে স্মৃতিশক্তি, দাবি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের

২০১৪ সাল থেকে সিসাদূষণ নিয়ে গবেষণা করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের একটি দল
ছবি: ফুয়াদ পাবলো

দিন দিন বাড়ছে ব্যাটারিচালিত যন্ত্রের ব্যবহার। ব্যাটারির অন্যতম উপাদান সিসা। একটি পরিত্যক্ত ব্যাটারির সিসা পরিবেশের সঙ্গে মিশে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা নিয়েই গবেষণা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। কীভাবে শুরু হলো এই কার্যক্রম? কী উঠে এল তাঁদের গবেষণায়?

শুরুটা যেভাবে হলো

মাত্রই তখন পিএইচডি করে দেশে ফিরেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপের সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন। একাডেমিক ব্যস্ততা শেষে যখন নিজের বিভাগে থিতু হলেন, গবেষণার জন্য একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র খুঁজছিলেন। বাইরের দেশে ইলেক্ট্রো ফিজিওলজি, মলিকুলার বায়োলজি, নিউরো ফিজিওলজি নিয়ে কাজ হলেও আমাদের দেশে এসব নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। তবে হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকেননি তিনি। বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে কীভাবে ভালো কিছু বের করে আনা যায়, সেই চেষ্টা করছিলেন। তখন বিভাগের ল্যাবে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করার কারণে মানবদেহে সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে নানা গবেষণা চলছিল। প্রাথমিকভাবে কিছু পানি পরীক্ষা করে দেখা গেল, পানিতে আর্সেনিকের পাশাপাশি স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে সিসা ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতি আছে। এ থেকেই গবেষণার ‘আইডিয়া’ পেয়ে যান জাহাঙ্গীর আলম। পানিতে সিসার উপস্থিতি কীভাবে বাড়ল, মানুষের মস্তিষ্কে এই সিসা কী ধরনের প্রভাব ফেলে, এসব নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির ইঁদুরের ওপর শুরু হয় গবেষণা কার্যক্রম।

যা পাওয়া গেল

বিভাগের এই ল্যাব থেকে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত এ–সংক্রান্ত তিনটি গবেষণাপত্র (কিউ-১) বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আরও তিনটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। এসব গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, উচ্চমাত্রার সিসামিশ্রিত পানি পানের কারণে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ইঁদুরের আচরণে পরিবর্তন ধরা পড়ে। ইঁদুরগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অস্থিরতা দেখা যায়। সেই সঙ্গে তাদের স্মৃতিভ্রম ও শেখার ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো প্রমাণও পাওয়া গেছে।

তাঁরা কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জেনেছেন, সব রকম বাধা অতিক্রম করে সিসার একটি অংশ মস্তিষ্কের আশপাশে জমা হয়ে ‘অক্সিডেটিভ স্ট্রেস’ বাড়ায়। মস্তিষ্কের কোষে ‘অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট’ পদ্ধতিকে দুর্বল করে। এটিই মূলত আচরণগত পরিবর্তনের বড় কারণ। গবেষক দলটি আরও জেনেছে, বংশপরম্পরায় সিসার এই ক্ষতিকর প্রভাব কয়েক গুণ বাড়ে। অর্থাৎ ইঁদুরের স্মৃতিশক্তি, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত করে সিসা। যেটি একই রকমভাবে মানুষের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।

কিন্তু এত সব নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনের জন্যও কোনো উপায় কি বের করা সম্ভব? সেই খোঁজই করছিল একই গবেষণাগারের আরেকটি দল। দলের অন্যতম সদস্য তাসনিম তাবাসসুম বলেন, ‘ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝতে পেরে আমরা এই ক্ষতি কমানোর উপায়ও খুঁজতে শুরু করেছিলাম। আক্রান্ত ইঁদুরগুলোকে আমরা ভাঁটপাতার নির্যাসমিশ্রিত পানি দিই। তখন দেখা যায়, এই নির্যাস ইঁদুরের ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমন করতে সক্ষম।’

সচেতনতার বিকল্প নেই

সিসাদূষণের ক্ষতি থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে সচেতনতার বিকল্প নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ব্যাটারিগুলো রিসাইকেল করার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। ঢাকায় নির্দিষ্ট কিছু স্থান থাকলেও পরিপূর্ণ রিসাইকেল প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় না। আবার ব্যাটারি থেকে সিসা গলিয়ে যখন আলাদা করা হয়, তখন সিসার অংশবিশেষ বিভিন্নভাবে মাটি ও পানিদূষণ ঘটায়। ব্যাটারিগুলোয় যে সিসার প্লেট থাকে, সেগুলো ভাঙা হয় আবার ব্যবহার করার জন্য। সিসা গলানোর সময় যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়, তাতে কিছু পরিমাণ সিসা বাতাসে মিশে যায়। পরে নিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। আবার গলিত সিসা মাটির সঙ্গে মিশে যায়। পরে এই সিসা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। শস্যদানা ও চাষ করা মাছের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে।’

পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির ইঁদুরের গবেষণা চালানো হয়েছে

তাই সিসাদূষণ রোধে জাতীয় পর্যায়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করছেন গবেষকেরা। আইনের প্রয়োগ, যথাযথ পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা তৈরির পাশাপাশি পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েরও সহযোগিতা প্রয়োজন, বলছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম আকন্দ বলেন, ‘বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি আছে, এ কথা আমরা জানি। পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পকারখানা, বিশেষ করে ব্যাটারি, ট্যানারি, কেমিক্যাল কারখানাগুলোর কারণে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ভারী ধাতুর উপস্থিতিটা বেশি, বিশেষ করে লেড, আর্সেনিক ক্রোমিয়াম। সিসা নিয়ে গবেষণা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা মূলত দেখার চেষ্টা করেছেন, এর কোনো নিউরোবিহেভিয়রাল প্রভাব আছে কি না। তাঁরা মূলত ‘মাইস মডেলে’ (ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা) কাজ করেছেন। অর্থাৎ এটি একইভাবে মানুষের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। আমি মনে করি, গবেষণার যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তা আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ একধরনের হুমকির মধ্যে আছে। এখন থেকেই সচেতন হওয়া দরকার।’