বছর ঘুরে আবার আসছে বড়দিন। বিশেষ খাবার, সাজপোশাক, সান্তা ক্লজের সঙ্গে সাক্ষাৎ, উপহার বিনিময় আর সর্বোপরি বিশেষ প্রতীক ক্রিসমাস ট্রির বর্ণিল আলোকসজ্জা নিয়ে এই দিনে প্রতিবছর উদ্যাপিত হয় যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন। আয়োজনটা ছোট হোক বা বড়, আনন্দ সবার মধ্যে ভাগ করে নেওয়াটাই আসল।
বড়দিনের অন্যতম লক্ষ্য, পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানো। বিশেষ করে যাঁরা দূরদূরান্তে থাকেন, এই সময়ে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হন তাঁরা। অতিথি এলে দিনটি যেন আরও জমে ওঠে।
এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় বড়দিনের প্রস্তুতি। ঠিক যেমন নতুন শিশুর আগমনের আগে গোটা পরিবারে চলে নানা পরিকল্পনা আর প্রস্তুতি। বাংলায় এই সময়কে বলে ‘আগমনকাল’। ডিসেম্বরের প্রথম দিক থেকেই শুরু হয়ে যায় গির্জা ও ঘর সাজানো। এ ছাড়া বিশেষ খাবারের প্রস্তুতি, প্রিয়জনের জন্য উপহার কেনা, সাজপোশাক, যিশুর স্মৃতিবিজড়িত গোশালা বানানো, ক্রিসমাস ক্যারলের অনুশীলনসহ নানা আয়োজন। এই আগমনকালের অবসান ঘটে ২৪ তারিখ রাতে, এরপর ২৫ তারিখ উদ্যাপন করা হয় বড়দিন।
এই আনন্দঘন আয়োজনের রেশ থেকে যায় একদম নতুন বছর পর্যন্ত। এ সময় কারও সঙ্গে দেখা হলেই হাত বাড়িয়ে কুশল বিনিময় করে বলা হয় ‘মেরি ক্রিসমাস অ্যান্ড হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
প্রি–ক্রিসমাস পার্টি
ক্রিসমাসের আগে ঘটা করে উদ্যাপন করা হয় প্রি–ক্রিসমাস বা প্রাক্–বড়দিনের পার্টি। মূলত এটা একটা পুনর্মিলনী। উৎসব মানে তো প্রিয়জনদের কাছে পাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে সময়ের হিসাব না করে আড্ডা দেওয়া। তাই এই আয়োজন চলতে থাকে বড়দিন আসার আগপর্যন্ত। সঙ্গে থাকে কেক, পিঠা, পেস্ট্রি ও ব্রাউনি। আয়োজনে স্থান পায় ক্রিসমাস ক্যারল আর উপহার বিনিময়।
ক্রিসমাস ট্রি ও গোশালা
বড়দিনের সাজসজ্জার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কনকনে শীতের রাতে বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে জন্ম নিয়েছিলেন যিশু। কারণ, যিশুর মা মারিয়ামের তখন যাওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিল না। তাই মারিয়াম জীর্ণ এক গোশালায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে জন্য প্রতীকী অর্থে প্রতিটি ঘরে, বারান্দায় কিংবা গাছে নানা থিমে গোশালার আকৃতিতে সাজানো হয় ঘর। কাপড় কিংবা শণের তৈরি ছোট্ট এই ঘরে রাখা হয় সদ্য জন্ম নেওয়া যিশুর মূর্তি। সেখানে থাকে নানা ধরনের আলোকসজ্জা।
বড়দিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ক্রিসমাস ট্রি। ছোট বা বড়, আকৃতি যা–ই হোক, এই গাছের সাজসজ্জায় থাকে রংবেরঙের টুনি বাতি, কৃত্রিম ফুল, রঙিন ফিতা, রঙিন মোজা, নানা ধরনের রঙিন বলসহ অন্যান্য উপকরণ। গাছের একদম চূড়ায় থাকে যিশুর জন্মের বিশেষ প্রতীক তারা বা স্টার। গাছের নিচে থরে থরে সাজানো থাকে উপহার। বিশেষ করে পরিবারের ছোটদের জন্য থাকে এই উপহার। তারা বিশ্বাস করে, এই উপহারগুলো শুধু তাদের জন্যই রেখে গেছেন সান্তা ক্লজ।
বড়দিনে সজ্জায় গুরুত্ব পায় নানা ধরনের ক্রিসমাস লাইট। বাড়ির ভেতর থেকে শুরু করে বাইরের অংশ, এমনকি গাছও সাজানো হয় আলো দিয়ে। ঝুলিয়ে রাখা কার্ড এবং নানা নকশার মোমবাতিও বাদ পড়ে না। খাবারের টেবিলও সাজানো হয় সুন্দর করে। বড়দিনের আকর্ষণ হিসেবে রাখা হয় ক্রিসমাস ট্রির ছোট মডেল, রঙিন বল, ফুল বা ছোট মোমবাতি। উৎসবের আমেজ আনতে ব্যবহার করা হয় লাল, সোনালি, সবুজ, সাদা রঙের রুমাল বা কাপড়।
বড়দিনের ঐতিহ্যবাহী খাবার
বড়দিনের প্রধান আকর্ষণ ক্রিসমাস কেক। বাটারক্রিমে ভরপুর ঘরে বানানো ভ্যানিলা বা চকলেট স্বাদের ক্রিসমাস কেকের তুলনা নেই। পশ্চিমা দেশে যেমন কেক বেশি গুরুত্ব পায়, আমাদের দেশে তেমনি বড়দিনের মূল আয়োজনের মধ্যমণি পিঠা। আমাদের গাজীপুর এলাকায় কেকের আদলে বিক্কা পিঠা বানানোর চল বহু পুরোনো।
এ তালিকায় আরও আছে ভাপা, পুলি, পাকন, পাটিসাপটা, ডোনাট, চিরুনি পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা। এ ছাড়া বাড়ির ছোটদের সঙ্গে নিয়ে চকলেট কুকিজ, সুগার কুকিজ, জিনজার ব্রেডম্যান আর ব্রাউনি বানানোর মজাই আলাদা। দুপুরের খাবারে বিশেষ গুরুত্ব পায় পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি, সালাদ, মুরগির রোস্ট, লবণ দেওয়া গরুর পদের মতো ঐতিহ্যবাহী খাবার।
আমাদের দেশে বড়দিনের খাবারে এলাকাভিত্তিক কিছু বিশেষ পদও আছে। যেমন নবাবগঞ্জের আঠারোগ্রাম এলাকায় একধরনের খাবার রান্না করা হয়, নাম ভাজাকারি। বেগুন ও বড় মাছ (বোয়াল, পাঙাশ, রুই) দিয়ে তৈরি হয় এটি। রান্না করা হয় পানি ছাড়া। অন্যদিকে বড়দিনে গাজীপুর এলাকার খ্রিষ্টানদের একটা প্রিয় পদ পর্তুগিজ খাবার ভিন্দালু। বিশ্বব্যাপী বড়দিনে নৈশভোজে আস্ত টার্কির রোস্ট করা হয়। স্পেশাল এই পদ দেশে আস্ত মুরগি দিয়েই করা যায়।
উপহার আর ক্যারল
বড়দিনের অন্যতম মূলমন্ত্রই হচ্ছে অপরের জন্য বাঁচা। যাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন কথা নেই, মনোমালিন্য হচ্ছে, তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া। তাই এই আনন্দের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি হলো উপহার বিনিময়। পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে অতিথি, বন্ধুবান্ধব একে অপরকে নানা ধরনের উপহার দেয় এ সময়।
শিশুরা ক্রিসমাসের আগের রাতে এই ভেবে ঘুমায় যে সান্তা ক্লজ তাদের জন্য উপহার রেখে যাবেন চুপি চুপি। মা–বাবার চেয়ে বড় সান্তা ক্লজ কি আর আছে! তাঁরাই রঙিন কাগজে মুড়ে জায়গামতো রেখে দেন সবার প্রিয় উপহার। আসলে উপহারের কোনো বড়–ছোট নেই। ক্রিসমাস কার্ড, চকলেট, কফি, পছন্দের ফুল বা হিম হিম দিনে দারুণ একটি চায়ের মগ—এসবই বড়দিনে উপহার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। পরিবারের আপনজন বা বন্ধুদের জন্য অনেকেই পোশাক, সাজসজ্জার সামগ্রী বা তাদের শখের কিছু দেয় উপহার হিসেবে।
অন্যদিকে বড়দিনের আনন্দকে এক ধাপ বাড়িয়ে দেয় ক্রিসমাস ক্যারল। প্রি–ক্রিসমাস থেকে শুরু করে বড়দিনের পর পর্যন্ত গির্জায় আর বাড়িতে বাড়িতে চলতে থাকে এই ক্যারল। যেহেতু আমরা বাঙালি, তাই বাংলা ভাষাতেই ক্রিসমাস ক্যারল করার চেষ্টা করি। এটাকে বলা হয় কীর্তন। হারমোনিয়াম, খোল, করতাল আর মন্দিরার তালে তালে জমে ওঠে কীর্তন।
সাজপোশাকে বড়দিন
ক্রিসমাসের প্রতীক মিসলটোপাতা দিয়ে বানানো ‘রিথ’-এ থাকে তিনটি রং। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড়দিনের সাজপোশাকে গুরুত্ব পায় লাল, সাদা ও সবুজ রং। তবে ক্রিসমাস পার্টিতে জমকালো সাজের জন্য অনেকেরই পছন্দ চুমকিসজ্জিত কিংবা ঝালর দেওয়া পশ্চিমা পোশাক।
উৎসব আর শীতের কথা মাথায় রেখে মেকআপে গুরুত্ব পায় শিমার, গ্লিটার। অনেকের পছন্দ আবার দেশীয় সাজপোশাক। অন্যদিকে বড়দিনে ছেলেদের প্রথম পছন্দ স্যুট, ব্লেজার।
ঘুরে বেড়াতে অনেকে হুডি, সোয়েট শার্ট, টার্টলনেক কিংবা ক্রিসমাস থিমের সোয়েটারও পরেন। আবার ক্রিসমাসের আমেজে সান্তা ক্লজের টুপি আর কোট এদিন অনেকেই পরেন।