২ হাজার ৭০০ বর্গফুটের বাসার ছাদে চারটি পৃথক স্তর জুড়ে আছে এই ছাদবাগান। আছে ফুল–ফল–সবজি।
সবুজে ঘেরা, পাখিডাকা পার্কে চায়ের কাপে একটা চুমুকই দূর করে দিতে পারে সারা দিনের ক্লান্তি! পার্কের আদলে এমনই একটা বাগান গড়ে তুলেছেন ঢাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম কবির খান। নিজের ২ হাজার ৭০০ বর্গফুটের বাসার ছাদে চারটি পৃথক স্তর জুড়ে আছে এই ছাদবাগান।
রং বাহারি ফুলের রাজ্য
‘নাহার ডেল’ ভবনের প্রবেশ ফটকেই স্বাগত জানাবে বাগানবিলাস, চন্দ্রপ্রভা, সাইকাস ও এক সারি বকুল ফুলের গাছ। তাদের অভ্যর্থনা নিয়ে লিফটে চড়ে সোজা ছাদ! ছাদে ওঠার সিঁড়িগুলোতেও সবুজের উপস্থিতি। সিঁড়ি পেরিয়ে ছাদের দরজা খুলতেই মনে হলো যেন মুহূর্তেই চলে এসেছি কোনো ফুলের রাজ্যে! চোখধাঁধানো সব রঙিন ফুল যেন মিছিল করছে!
ডানে, বাঁয়ে, সামনে—এমনকি মাথার ওপরও ঝুলছে রঙিন পিটুনিয়া ফুলের দল। টকটকে লাল, গোলাপি থেকে শুরু করে সাদা, নীল, বেগুনি, খয়েরি ও বিভিন্ন রঙের পিটুনিয়া ফুল। ছাদে যে-ই ওঠেন, প্রথমে পিটুনিয়ার রূপে মুগ্ধ হন, না চাইতেও হাতে ওঠে মুঠোফোন, চলে ক্লিক ক্লিক। পিটুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে বিভিন্ন রঙের শীতের ফুল—চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, গাঁদা, এস্টার, জারবেরা, ডালিয়া, গোলাপ, জিনিয়া, সিলভিয়া। আছে বিভিন্ন রঙের কাঁটামুকুট, বাগানবিলাস, ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী মরুগোলাপ এডেনিয়ামসহ অনেক ফুল।
সফিকুল ইসলাম জানান, বছরজুড়েই ফুলের উপস্থিতি থাকবে, এমনভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে সব ফুলের চারা। এই শীত শেষে শীতের ফুল বিদায় নিলে বাগান আলো করে হাজির হবে এমারেলিস লিলি, এডেনিয়ামসহ সুপ্ত অবস্থায় থাকা মে ফ্লাওয়ার, সোর্ড লিলি, রেইন লিলি। আর বারান্দায় আছে বিভিন্ন অর্কিড।
আছে কদম, ছাতিম, সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুল, হিজলের মতো বড় বৃক্ষজাতীয় ফুলগাছ। বনসাই রূপে গড়ে অপেক্ষা করতে চান ফুল দেখা পর্যন্ত।
ফলের যত সংগ্রহ
ফলের মধ্যে ছাদজুড়ে চোখে পড়ে আমের রাজত্ব। কোনো গাছে মুকুল তো কোনো গাছে মার্বেল আকৃতির আম। বারোমাসি আম বলে কোনো গাছে এই শীতেই ঝুলছে থোকা থোকা ঢাউস আকৃতির আম। গাছের পাতা থেকে শুরু করে মুকুলের রং কালচে খয়েরি, আমের নাম ব্ল্যাক স্টোন। আছে কাস্তে আকৃতির মহাচানক, রঙিন আমেরিকান পালমার, বারোমাসি থাই কাটিমন, থাই নাম ডক মাই, থাই ব্যানানা আম, বারোমাসি মালয়েশিয়ান লুবনা, হাঁড়িভাঙা, কিউজাই, পুনাই, চেন্নাইসহ অনেক জাতের আম। ফলে সারা বছরই কোনো না কোনো গাছে থোকা থোকা আম থাকে।
জাতীয় ফল কাঁঠালও আছে! ছাদে ড্রামের মাটিতেই দিব্যি ফল নিয়ে হাজির ভিয়েতনামি বারোমাসি আঠাহীন কাঁঠাল। আছে ফলসহ আনার, আমলকী, আমড়া, সফেদা, থাই কদবেল, লেবু, থাই বাতাবিলেবু। আছে দেশ–বিদেশের কয়েক জাতের মাল্টা, কমলা, জাবুটিকাবা, আপেল, আঙুর, পেয়ারা, জামরুল, লঙ্গান, রাম্বুটান, ড্রাগন ফল।
সবজির মেলা
ফুল–ফলের পাশাপাশি চলে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, শসা, ঢ্যাঁড়স, করলা, চেরি টমেটো, মরিচ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন সবজির চাষ। এখন ছাদে ঝুলছে শীতের লাউ, কলমিশাক, পালংশাক, মুলাশাক, ধনেপাতা, থানকুনিপাতা আর থোকা থোকা ধরে থাকা চেরি টমেটো। বাগানে অতিথি হয়ে যে–ই আসছেন, টসটসে রসাল রঙিন চেরি টমেটো দিয়ে শুরু হচ্ছে আপ্যায়ন।
ক্যাকটাস, পাতাবাহার ও অন্যান্য
ছাদের একটা অংশজুড়ে শোভা বাড়াচ্ছে অনেক প্রজাতির কাঁটাময় ক্যাকটাস। স্নো কুইন, মার্বেল কুইনের মতো পোথোস, অ্যাগ্লোনিমা, অ্যান্থুরিয়াম, বার্ড নেস্ট, ক্রোটন, পেপেরোমিয়া, সিঙ্গোনিয়াম, ফিলোডেন্ড্রন, সিলভারস্টাইন, স্পাইডার প্ল্যান্ট, স্নেক প্ল্যান্ট, জিজি প্ল্যান্ট, সাকুলেন্টসহ অনেক প্রজাতির পাতাবাহারগাছ আছে ছাদ, বারান্দা এমনকি ঘরের ভেতরেও। বারান্দাজুড়ে চোখে পড়ে অর্কিডের সমারোহ।
পাখপাখালির আসর
ছাদের এক কোনায় কিচিরমিচির করে মাতিয়ে রাখে মুনিয়া, কবুতর, বাজরিগর, তিলা ঘুঘু। এদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসে প্রতিবেশী চড়ুই, টিয়া, বুলবুলি, বাদুরসহ আরও অনেকে। ছাদের সফেদার শতকরা ৯৫ ভাগই চলে যায় পাখিদের দখলে! তবু আফসোস নেই। পাখিদের আপ্যায়নেও কমতি নেই। পোড়ামাটির ট্রেতে সব পাখির জন্যই খাবার রাখেন সফিকুল ইসলাম। থাকে পানিও—পাখা ঝাপটে গোসলও সেরে নেয় ছোট্ট এই সুইমিংপুলে!
পারিবারিক যেকোনো আয়োজন থেকে শুরু করে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা, দাওয়াত—সবই হয় এখানে।
বাগান শুরুর আগে প্রথমেই অভিজ্ঞ বাগানিদের পরামর্শ নিতে হবে, বললেন সফিকুল ইসলাম। তাঁর নিজের পরামর্শ, পরিচিত ও বিশ্বস্ত নার্সারি থেকে ছাদবাগান উপযোগী ঠিক জাতের উপযুক্ত চারা নির্বাচন করা ভালো। মাটিতে পর্যাপ্ত জৈব সার ও রোগমুক্তিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করুন।
ছাদে বাগান করার সময় যেসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি
ভাড়া করা বাসায় থাকার সময় থেকেই সফিকুল ইসলামের নিজের মতো একটি বাগান করার শখ। তাই নিজেদের বাড়ির কাজ যখন ধরলেন, শুরুতেই স্থপতিকে বলে দিলেন, ছাদ হতে হবে বাগান করার উপযোগী। তাই ছাদের ধারণক্ষমতার ওপর নির্ভর করে টব ও ড্রামের পাশাপাশি গড়েছেন চারটি স্থায়ী বেড। স্যাঁতসেঁতে ভাব ঠেকানোর জন্য ছাদে দেওয়া হয়েছে রাসায়নিকের আস্তরণ।
ছাদবাগান গড়ে দেওয়া থেকে শুরু করে বাগান পরিচর্যার জন্য গাছের পরিচর্যা, ল্যান্ডস্কেপিং, হাইড্রোপনিকস ও নগর সবুজায়ন নিয়ে কাজ করে ‘গ্রিন সেভার্স’। এটির প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি জানান, ছাদে বাগান করার সময় কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন—
• গাছপালার ভার সহ্য করতে পারে এমন ছাদে বাগান করা উচিত। ছাদটি হতে হবে দ্রুত পানিনিষ্কাশনের উপযোগী।
• খেয়াল রাখতে হবে, কোনোভাবে ছাদ যেন ড্যাম্প বা স্যাঁতসেঁতে না থাকে। এ জন্য লোহার তৈরি কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি উঁচু ফ্রেম, রিং বা তিন থেকে পাঁচটি ইটের ওপর ড্রাম, টব বা বাক্স স্থাপন করতে হবে। এতে পাত্রের নিচ দিয়ে আলো–বাতাস চলাচল করতে পারবে। ছাদও স্যাঁতসেঁতে হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
• পানিরোধক (ওয়াটারপ্রুফিং), নেট ফিনিশিং বা চিপস ঢালাইয়ের মাধ্যমেও ছাদ স্যাঁতসেঁতে প্রতিরোধী করা যায়।
• গাছ রোপণের জন্য ছাদে স্থায়ী বেড বানাতে চাইলে ছাদ থাকে অন্তত আট ইঞ্চি ওপরে কাঠামো বানাতে হবে।
• বড় গাছকে ছাদের বিম বা কলামের কাছাকাছি ঠাঁই দিতে হবে।
• গাছপালা ঘন হলে দ্রুত বাড়তে পারে না। আবার এক গাছ থেকে আরেক গাছে দ্রুত রোগ সংক্রমিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। এ জন্য ছাদে বাগান করার আগে কতটুকু জায়গায় বাগান করবেন ও কোন গাছ কতটা দূরে রাখবেন, তার একটি পরিকল্পনা ও নকশা করে নিতে হবে।